Marxists Internet Archive
Bangla Section


ডেমোক্রেটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

সম্পাদকীয় পরিশিষ্ট

প্রাচীন গ্রীসের পরমাণুবাদ
পরমাণুবাদ হল বস্তুর গঠন সংক্রান্ত মতবাদ। এখানে বস্তুর বিভিন্ন অংশের মাধ্যমে গঠনের কথা বলা হয়। এ তত্ত্ব প্রথমে প্রাচীন ভারতের ন্যায় এবং বৈশেষিক দর্শন তত্ত্বে বলা হয়। পরে গ্রীসের দার্শনিক লিউসিপ্পাস, ডেমোক্রিটাস, এপিকিউরাসের মাধ্যমে তা আরো সুসংবদ্ধ রূপ পায়। লিউসিপ্পাস (৫০০-৪৪০ খৃ. পূ.) ডেমোক্রিটাসের সমসাময়িক। তার মাধ্যমেই গ্রীসে সুসংস্কৃত পরমাণুতত্ত্বের উদ্ভব হয়। তিনি তিনটি নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন (১) পরম শূন্যতা, (২) এই পরম শূন্যে ধাবমান পরমাণু, (৩) যান্ত্রিক প্রামাণিকতার ধারণা। তিনি বলতেন জ্ঞজ্ঞকারণ ছাড়া কিছুই ঘটেনা, সব কিছুরই কোন না কোন ভিত্তি এবং আবশ্যিকতার শক্তি আছে।ঞ্চ
পরমাণুবাদের চর্চাঞ্চর ভিত্তি তৈরী করেছিলেন এমপিডক্লেস (৪৮৩-৪২৩ খৃ.পূ)। তিনি পারমানাইডিস এবং হেরাক্লিটাসের মতবাদের সমন্বয়ের চেষ্টা চালান। তাঁর মূল কথা হল - চরম বলতেও কিছু নেই, হয়ে ওঠা বলতেও কিছু নেই। সত্তা থেকে অসত্তায় বা অসত্তা থেকে অসত্তায় প্রবেশের কোন পথ নেই। তবু বস্তুর উৎপত্তি ও লয়ের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলছেন যে তাও ঘটে সমগ্রের হিসেবেই। পুরো বিষয়জগতে তাতে কোন বাড়তি বা কমতি ঘটছেনা। যে বস্তু কণিকা দিয়ে বস্তু তৈরী তা চিরন্তন ও শাশ্বত। এমপিডক্লেসের এই অস্পষ্ট ধারণার ওপরেই লিউসিপ্পাস ও ডেমোক্রিটাসের পরমাণুতত্ত্ব দাঁড়ায়। তাঁরা বললেন- বস্তুকে ক্রমাগত যদি ছোট করতে থাকি তাহলে এক সময় তাকে আর ছোট করা যাবেনা। ঐ অবিভাজ্য, সরলতম বস্তু কণিকাই পরমাণু। পরমাণু বস্তুর আদি উপকরণ। তারা সব একই ধরনের, কোন প্রকার গুণহীন। বস্তুর গুণ পরমাণুর অবস্থান, বিন্যাসের ভিন্নতার কারণেই ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে পরমাণুকে যদি আর বিভাজন না করা যায় তাহলে তার দুটো গুণ পাওয়া গেল - তাদের ঘনত্ব এবং অবিভাজ্যতা। তাদের কি কোন ওজন আছে? এটি একটি বিরাট প্রশ্ন। তা নিয়ে পরে এপিকিউরাস ও তাঁর অনুসারীরা নিজস্ব মত দেন।
ডেমোক্রিটাস (৪৬০- ৩৭০ খৃ. পূ.) দুটি আদি সূত্রপাতের কথা বলেন -- পরমাণু এবং শূন্যতা। অসীম শূন্যতায় অসীম সংখ্যক পরমাণু চিরন্তনভাবে গতিশীল। বিভিন্ন দিকে চলার কালে পরমাণুগুলো মাঝে মাঝে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে পরমাণুর ঘূর্ণি তৈরী করে। অসীম সংখ্যক জগত জন্মাচ্ছে, মরে যাচ্ছে। তা কোন দেবতা হতে নয় বরং বিদ্যমানতার স্বাভাবিক আবশ্যিকতায়। ডেমোক্রিটাস কার্য-কারণ ও আবশ্যিকতাঞ্চর কথা মেনে আকস্মিকতাকে অঞ্চানতার ফল বলে মানেন। তিনি দাসতান্ত্রিক অভিজাততন্ত্রের বিরোধিতা করে একে আদিম ধরনের গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়েছিলেন।
এপিকিউরাস (৩৪১- ২৭০ খৃ. পূ.) লিউসিপ্পাস এবং ডেমোক্রিটাসের পরমাণুবাদে নিজস্ব পরিবর্তন এনে তাকে পুনর্জীবিত করেন। তিনি এই তত্ত্বে পরমাণুর নিজের পথ হতে স্বতঃস্ফূর্ত (নিজের ভেতরে শর্তায়িত) বিচ্যুতির ধারণা সংযোজন করেন। ফলে স্থানে সমান গতিতে ধাবমান পরমাণুদের সংঘর্ষের সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করা গেল। এটি ছিল আবশ্যিকতা এবং সুযোগের আন্তঃসম্পর্কের আরো গভীর অনুধাবনের ভিত্তি, যা কিনা ডেমোক্রিটাসের যান্ত্রিক নির্ধারণবাদের চাইতে অগ্রসর ধারণা ছিল। এপিকিউরাস বলতেন যে পরমাণুর ওজন আছে, এই ওজনঞ্চই ছিল পরমাণুর মূল গতির উৎস। এই ওজনের জন্যই সে অনন্ত মহাবিশ্বে নীচে ধাবিত হচ্ছে। ভারী পরমাণুগুলো দ্রুত ধাবিত হবার ফলে হালকাগুলো ঠেলে সরিয়ে দেয়, ফলে সৃষ্টি হয় এক আবর্ত। এই আবর্তে পরমাণুর সংযোগেই জগত সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট-জগত অসংখ্য।
ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী ১৮৪৮ পর্যন্ত য়ুরোপে শ্রমিক আন্দোলন
শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লবের পর হতে য়ুরোপে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই তা পরিস্ফুটিত হতে থাকে অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের সংগ্রামের মাঝ হতে।
১৭৯০- মেশিন ভাঙা লা-াইট আন্দোলন- জেনারেল নেড লাড, ব্রিটেন লাইসেষ্টারের জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা। তার নামেই পরিচিত লা-াইট আন্দোলন।
এর কারণ একাধিক হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে যন্ত্রের প্রবর্তন। ব্রিটেনে সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয় সুতি বস্ত্র শিল্পে। শিল্প বিপ্লবের পরবর্তীতে যন্ত্র শিল্পের আর্বিভাব মানে ছাঁটাই, অনিশ্চয়তা, দারিদ্র, বেকারত্ব। মেশিন প্রবর্তনই শ্রমিকের জীবনে অভিশাপ- এই ধারণা থেকে জন্ম নেয় কারখানা, মালের গুদামে আগুন দেয়া, যন্ত্রপাতি লুন্ঠন ও ধ্বংসের আন্দোলন। এই আন্দোলন সবচাইতে হিংসাত্মক রূপ নেয় ব্রিটেনের ল্যাঙ্কশায়ারে ১৭৯৯- ১৮২৬, উইল্টশায়ারে ১৮০২, নটিংহামশায়ারে ১৮১১- ১২, বাকিংহামশায়ারে ১৮৩০ সালে। ফ্রান্সে ১৮০৭- ২৩ সালে ভিয়েন, লিয়ঁ প্রভৃতি স্থানে। বেলজিয়ামের ব্রুসেলস, লীজ, আইপেন ১৮২১- ৩০, জার্মানীর আখেন ড্যুসেলডর্ফ ১৮৩০- ৩৪, পোলেন্ডের লৎস-এ ১৮৩৪, ১৮৩৮, ১৮৬১ সালে।
এই আন্দোলন শাসক শ্রেণীকে ব্যাপকভাবে আতঙ্কিত করে। আন্দোলন প্রতিহত করতে ১৮১১- ১২ সালে প্রেরিত ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর শক্তি ১৮০৮ সালে পর্তুগালে প্রেরিত তাদের ফৌজিবাহিনীর থেকে বেশি (১২০০০) ছিল। ১৮১২ সালে, তার পরপরই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দমনমূলক ব্যবস্থার নামে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করে। এর বিরুদ্ধে লর্ড সভায় বায়রণের সোচ্চার প্রতিবাদ স্মরণীয়। এঙ্গেলস তার জ্ঞজ্ঞইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থাঞ্চঞ্চ গ্রন্থে মেশিনভাঙা আন্দোলনের বিশ্লেষণ করে একে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন।
গুপ্ত সমিতি- লা-াইট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের মাঝে শ্রেণী বোধ গড়ে উঠতে শুরু করে। ব্রিটেনে আন্দোলনকালে লা-াইটদের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠে। ১৮২২ সালে ল্যাঙ্কারশায়ার ও ইয়র্কশায়ারে আন্দোলনকারীরা সুস্পষ্ট, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করে।
ধর্মঘট- অর্থনৈতিক চাহিদাকে মোদ্দা কথা করে ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রতিবাদের পীঠস্থান ছিল ব্রিটেন। উল্লেখযোগ্য ছিল ১৮০৪- ০৫ ও ১৮১২ সালে স্কটল্যান্ডে তাঁতীদের, ১৮০৮ ও ১৮১০ সালে ল্যাঙ্কারশায়ারে সুতো শ্রমিকদের ধর্মঘট। ফ্রান্সে ১৮০৬ সালে পারীর ইমারত শ্রমিকদের মাধ্যমে ধর্মঘটের সূত্রপাত হয়। ১৮৩০- ১৮৪৭ পর্যন্ত ফ্রান্সে ৩৮২ টি ধর্মঘট হয়।
জার্মানী ও ইতালিতে ধর্মঘটের ব্যাপকতা ছিল কম। রাশিয়াতে ১৮৪৪ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ- মস্কো রেলপথ নির্মাণ কালে শ্রমিকরা অন্ততঃ ৪ বার ধর্মঘট করে; ১৮৬১- ১৮৬৯ পর্যন্ত রাশিয়াতে একাধিক ধর্মঘট পালিত হয়।
শিল্প বিপ্লবের প্রতিক্রিয়াতে শ্রমিক আন্দোলন বিকশিত হয় লা-াইট আন্দোলন ও ধর্মঘট ভিত্তিক অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার সংগ্রামে। ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে, বিগত সংগ্রামের অভিঞ্চতায় এতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী, জ্যাকেবিনদের বিপ্লবী গণতন্ত্রের আদর্শ, ১৮৩০ ও ১৮৪৮ এর ফরাসি বিপ্লবাদর্শ শ্রমিক শ্রেণীকে রাজনৈতিক অধিকারে সচেতন হতে হাত বাড়ায়। এই রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের কোন বিকশিত নিজস্ব আঙ্গিক ছিল না, নেতৃত্বে ছিল বুর্জোয়ারা। ফলে ফসল ওঠে তাদেরই ভাড়ারে। ফরাসি বিপ্লবের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আদর্শে প্রভাবিত শ্রমিক শ্রেণীর মাঝে পুঁজিবাদ ধ্বংস করে বিকল্প কোন নয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল না।
এই প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলন কিছু নির্দিষ্ট সুরত নেয়া শুরু করে। যেমন ব্রিটিশ শ্রমিকরা পার্লামেন্টে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে শুরু করে। উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল ভোটদানের অধিকার, পার্লামেন্টে শ্রমিক প্রতিনিধি প্রেরণ- এইসব।
পত্রালাপ সমিতি (ইষক্ষক্ষনড়সষশধভশফ জষদভনঢ়ঁ) গঠিত হয় বিভিন্ন দেশ ও জাতির শ্রমিক আন্দোলনের মাঝে যোগাযোগ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে; এবং তা-ই পরে শ্রমিক অধিকার আদায়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। জুতো সেলাই মিস্তিরি টমাস হার্ডির (১৭৫২- ১৮১২) নেতৃত্বে ১৭৯২ সালে প্রথম এই সমিতি আত্মপ্রকাশ করে। সমিতিগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মাঝে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করা, বাকি সব আন্দোলনের যোগসূত্র তৈরী করে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ব্রিটেনে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে লন্ডন সমিতি ইংরেজ শ্রমিকদের পক্ষ হতে ফরাসি জনগণকে গোপনে অভিনন্দন বাণী পাঠায়।
১৭৯৯ সালে ব্রিটেন পার্লামেন্ট পত্রালাপ সমিতি সহ শ্রমিকদের যে কোন সংগঠন বেআইনী ঘোষণা করে। কার্যত ১৭৯৯- ১৮২৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ শ্রমিকদের কোন প্রকারের সভা, সমাবেশ, সংগঠন করার আইনী অধিকার ছিল না। ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে বুরবঁ শাসনতন্ত্রের অবসান হলে য়ুরোপ জুড়ে শ্রমিক রাজনীতিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। কিন্তু ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রিফর্ম বিলে শ্রমিকদের জন্য আশাব্যাঞ্জক কিছু ছিল না।
চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয় এই প্রেক্ষিতে, ও ব্রায়েন, জি. জে হারল, আর্নেস্ট জোনস প্রমুখ শ্রমিক নেতাদের উদ্যোগে। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল গণমিছিলের মাধ্যমে শ্রমিকদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবি-পত্র পার্লামেন্টে পেশ করা। প্রথম চার্টার পেশ হয় ১২ লক্ষ স্বাক্ষর সহ ১৮৩৯ সালে, ১৮৪২ সালে দ্বিতীয় চার্টার ৩৩ লক্ষ স্বাক্ষর সহ। ১৮৪০ সালে চার্টিস্টদের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় মতাদর্শের অভাবে। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকার উচ্ছেদের প্রয়াস হয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ১৮২০ সালে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের প্রচেষ্টায়। এতে ৬০,০০০ বিভিন্ন পেশার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। ১৮৩১ ও ১৮৩৪ সালে লিঁয়তে রেশম শিল্পের যে শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে তাদের মাঝে জ্যাকোবিনদের বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রের আদর্শ গভীর প্রভাব ফেলেছিল। লিঁয়র এই ধর্মঘট শ্রমিক রাজনীতিতে মতাদর্শের প্রভাবের নতুন স্তর সূচিত করে। তার ধারাক্রমে ৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৪০ সালে সাধারণ ধর্মঘটে শ্রমিকরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষকালে শ্লোগান দেয়- অস্ত্র ধর! স্বৈরাচারী আর তার পা চাটাদের ধ্বংস কর!
৩০ ও ৪০ দশকে ১৯ঞ্চশ শতাব্দীর য়ুরোপে সব বিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ফ্রান্স।
জার্মান শ্রমিকদের বেআইনী বিপ্লবী সংগঠন ফ্রান্সেই গড়ে উঠেছিল।
জার্মানীতে লীগ অব জাস্ট প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩৬ সালে; এ. মেউরার, হাইনরিশ আহরেন্ডস, পরে ভি. ভাইটলিং, হ. বাউয়ের এর প্রচেষ্টায়; উদ্দেশ্য ছিল জার্মানীতে বিপ্লবী তৎপরতা পরিচালনা। ফরাসি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যোগ থাকলেও তার মূল কাজ ছিল শ্রমিকদের মাঝে তাত্ত্বিক ধারণার প্রচারণা। সাইলেশিয়ার তাঁতীদের ধর্মঘট (১৮৪৮) ছিল জার্মান শ্রমিকদের প্রথম বিস্তৃত রাজনৈতিক গণআন্দোলন।
ফরাসি বিপ্লব হতে ১৮৪০ পর্যন্ত জার্মানীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৭৮৯ ফরাসি বিপ্লব।
১৭৯৬ জার্মানীতে অষ্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের যুদ্ধ শুরু; ফ্রান্স পরাস্ত।
১৭৯৭ নেপোলিয়নের অষ্ট্রিয়া অভিযান। কেম্পো ফোর্মিও চুক্তি অনুসারে অষ্ট্রিয়া রাইন নদীকে ফ্রান্সের পূর্ব সীমানা স্বীকার করে।
১৭৯৯ ব্রিটেন, অষ্ট্রিয়া, পর্তুগাল, রাশিয়া ও নেপলস্‌ ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রজোট তৈরী করে।
১৮০১ লুনেভাইল চুক্তির মাধ্যমে অষ্ট্রিয়া ফ্রান্সকে রাইনের পশ্চিমাঞ্চল অর্পন করে।
১৮০৫ ব্রিটেন, অষ্ট্রিয়া, সুইডেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তৃতীয় রাষ্ট্রজোট গঠন করে। উল্‌ম এর যুদ্ধে অষ্ট্রিয়াকে পরাজিত করে নেপোলিয়ন বাহিনী নিয়ে ভিয়েনা অভিমুখে এগোন। ডিসেম্বরে অষ্ট্রিয়া ও রাশিয়ার সম্মিলিত বাহিনীকে নেপোলিয়ন চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। অষ্ট্রিয়া ও ফ্রান্স প্রেসবার্গ চুক্তি স্বাক্ষর করে। জার্মানী বহুধা বিভক্ত হয়।
১৮০৬ নেপোলিয়ন জার্মানীর পুনর্গঠন করেন। মূল কৌশল ছিল জার্মানীতে ক্ষুদ্র রাজ্যের সংখ্যা বাড়িয়ে অষ্ট্রিয়া ও প্রুশিয়ার শক্তি খর্ব করা। স্কোনব্রনের চুক্তি অনুসারে প্রুশিয়া রাইন উপকূলের কিছু অংশ ফ্রান্সকে অর্পন করে। পোল্যান্ডের কিয়দংশ, পশ্চিম প্রুশিয়ার কিছু অংশ নিয়ে নেপোলিয়ন ভেষ্টফলিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এসবের ফলে জার্মানীতে প্রুশিয়ার আধিপত্য খর্ব হয়। জার্মানীর ১৩ ক্ষুদ্র রাজ্য নিয়ে রাইন কনফেডারেশন গঠিত হয়। ফলে পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য বিনাশ লাভ করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৩০০ রাজ্যে বিভক্ত জার্মানীকে নেপোলিয়ন ৩৯ রাজ্যে পরিণত করে ভবিষ্যত ঐক্যের পথ সুগম করেন। নেপোলিয়নের শাসন সংস্কার ও তাঁর সিভিল কোড জার্মানীর সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।
ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আইনে সমতা, কৃষকের মালিকানা স্বত্ত্ব, বিপ্লবের আদর্শ ছিল নেপোলিয়ন কোড এর ভিত্তি।
ক্রমাগত হস্তক্ষেপে প্রুশিয়া ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জেনাতে পর্যুদস্ত হয়। প্রুশিয়া ফ্রান্সের দখলে আসে।
১৮০৯ সালে অষ্ট্রিয়া নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে পরাজিত হয়। ভিয়েনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রাইন রাষ্ট্র সংঘে ফরাসি শাসনের প্রতি তীব্র ক্ষোভ শুরু হয়, কিন্তু কর্মচারী ও সেনাবাহিনী ফ্রান্সের স্বপক্ষে থাকে। স্যাক্সনী, ভেস্টফলিয়া, ব্যাভেরিয়া রাজ্যের সেনাবাহিনী ফরাসি বাহিনীতে যোগ দেয়।
১৮১২ সালে নেপোলিয়নের রুশ অভিযানে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মর্ধবর্তী স্থানে অবস্থিত প্রুশিয়া ও অষ্ট্রিয়া নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে পারলো না। উভয়ই ফ্রান্সকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে। নেপোলিয়নের রুশ অভিযানে ব্যর্থতার পর প্রুশিয়ার জাতীয় অভ্যুত্থান ঘটে। এ বছর ডিসেম্বরে রুশ জার প্রুশিয়ার সেনাপতির সাথে টুরুজেন-এর চুক্তি করেন।
১৮১৩ সালের জানুয়ারিতে রুশ জার য়ুরোপীয় জনগণের মুক্তির কথা ঘোষণা করে। প্রুশিয়ার রাজা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রাইন রাষ্ট্র সংঘ ভেঙে পড়ে। সমগ্র উত্তর ও মধ্য জার্মানীতে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়, নেতৃত্বে থাকে প্রুশিয়া, অষ্ট্রিয়া প্রস্তুত, কিন্তু অপেক্ষমান থাকে। পূর্ব প্রুশিয়াতে রাজতন্ত্র বিরোধী গণঅভ্যুত্থান ঘটলে ফরাসিরা বার্লিন দখল করে। রাশিয়া, প্রুশিয়া, ব্রিটেন ও অষ্ট্রিয়া চতুর্থ ফরাসি বিরোধী রাষ্টজোট গঠন করে। রাশিয়া, প্রুশিয়া ও অষ্ট্রিয়া রাইকেনবাক সন্ধি করে স্থির করে যে, নেপোলিয়ন এর গঠিত রাষ্ট্র সংঘ ও অধিকৃত ভূমি পূর্বের মত বন্টিত হবে। লিপজিগের যুদ্ধে মিত্রপক্ষ নেপোলিয়ন বাহিনীকে বিধ্বস্ত করে। মিত্রপক্ষ নেপোলিয়নের কাছে ফ্রাঙ্কফুর্ট শান্তি প্রস্তাব পাঠায়। নেপোলিয়ন তা গ্রাহ্য না করে যুদ্ধে মিত্রপক্ষকে পরাস্ত করে।
১৮১৪ সালে অবশেষে মিত্রপক্ষ পারী দখল করে। ৬ এপ্রিল নেপোলিয়ন সিংহাসন ছেড়ে মিত্রপক্ষের সাথে ফঁতেব্লে সন্ধি স্বাক্ষর করে। ভিয়েনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় য়ুরোপের রাষ্ট্রবর্গের মাঝে, নেপোলিয়নের উত্থানে বিপর্যস্ত রাষ্ট্র সীমানা আবার ঠিকঠাক করতে। প্রথম চুক্তি হয় ৩০ মে, ১৮১৪; চূড়ান্ত চুক্তি ২০ নভেম্বর ১৮১৫। নতুন বিন্যাসে প্রুশিয়ার আয়তন দ্বিগুণ হল। অষ্ট্রিয়ার তুলনায় প্রুশিয়াই বেশি লাভবান হয়। সর্বোপরি ব্রিটেন, রাশিয়া, প্রুশিয়া ও অষ্ট্রিয়া হয়ে উঠে য়ুরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র। ভিয়েনা কংগ্রেসের পর প্রুশিয়ার প্রধান কাজ হল তার রাজ্যাংশকে ঐক্যবদ্ধ করা।
১৮১৬ ইহুদী বিরোধী আইন প্রবর্তিত হয় প্রুশিয়ায়।
১৮১৯ প্রুশিয়ার রাজা প্রতিনিধিমূলক সরকারের বদলে নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র প্রবর্তন করেন।
১৮২৩ প্রুশিয়াতে নামমাত্র প্রাদেশিক পরিষদ গঠিত হয়।
১৮২৭ প্রুশিয়ায় মন্ত্রী, প্রাদেশিক পরিষদের সভাপতি ও সমর নায়কদের নিয়ে রাজ্য পরিষদ গঠিত হয়।
১৮৩০ এর ফ্রান্সে বিপ্লব প্রচেষ্টার পর অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেওেরনিখ বিপদ্‌জনক চিন্তা নিয়ন্ত্রনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে। প্রুশিয়ার রাষ্ট্র তা সাদরে গ্রহন করে। তার পরবর্তি ফল হিসেবে প্রুশিয়াতে নব্য হেগেলীয়দের শিক্ষকতার চাকুরি রদ্‌ হয়।
১৮৪০ প্রুশিয়ার গদিতে নতুন প্রতিক্রিয়াশীল রাজার আরোহন।

পরবর্তী অংশ