Marxists Internet Archive
Bangla Section


ডেমোক্রেটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

দ্বিতীয় অংশ: বিস্তারিতভাবে ডেমোক্রিটিয় ও এপিকিউরিয় পদার্থবিদ্যার পার্থক্য

প্রথম অধ্যায়: সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয়
এপিকিউরাস শূন্যে পরমাণুর তিনভাগে বিভক্ত গতির কথা স্বীকার করেন। একটি গতি সরলরেখার উপর পতন, দ্বিতীয় গতিটি সরলরেখা থেকে পরমাণুর বিচ্যুতি এবং তৃতীয়টি অনেকগুলো পরমাণুর বিকর্ষণের ফলে উদ্ভব হয়। ডেমোক্রিটাস এবং এপিকিউরাস উভয়ে প্রথম এবং তৃতীয় গতিটি গ্রহণ করেছেন। সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয় একটি গতি থেকে অন্যটির পার্থক্য নির্দেশ করে।
ক্ষয়ের গতি প্রায়শঃই কৌতুকের বিষয়ে পরিণত হয়। আলোচ্য বিষয়ে হাত দিয়ে কিকেরো আর যে কারো থেকে মুক্ত কন্ঠ হন। তাঁর অন্যান্য লেখার মাঝে আমরা এও পড়ি:
জ্ঞজ্ঞএপিকিউরাস মনে করতেন যে, পরমাণুসমূহ তাদের ওজনের কারণেই বাধ্য হয়ে নিম্নমুখী হয়; এই গতিকে দেহের প্রাকৃতিক গতি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তখনই তাঁর কাছে এটা মনে হয় যে, যদি সকল পরমাণুই নিম্নমুখী হতে বাধ্য হত, তাহলে একটি পরমাণুর সাথে আরেকটির কখনোই দেখা হতো না। সে কারণে এপিকিউরাস একটি মিথ্যার আশ্রয় নেন। তিনি বলেন যে, পরমাণুগুলোর খুব, সূক্ষ্ম বিচ্যুতি ঘটে। কিন্তু এটা একদম অসম্ভব। এই থেকেই আসে জটিলতা, এর বিন্যাস ও পরমাণুগুলোর একটির সাথে আরেকটির শক্তভাবে লেগে থাকা এবং তা হতেই আসে জগত, এর সমস্ত অংশ ও আধেয় বস্তু। এই সব শিশুসুলভ উদ্ভাবন বাদ দিলে তিনি যা চেয়েছিলেন, তা অর্জন পর্যন্ত করেন নি।ঞ্চ
কিকেরোর প্রথম প্রবন্ধের বই জ্ঞজ্ঞদেবতাদের স্বভাব প্রসঙ্গেঞ্চঞ্চ- আমরা আরেকটি বিবৃতি খুঁজে পাই :
জ্ঞপরমাণুসমূহ তাদের নিজ ওজনে নিম্নমুখী হতে বাধ্য হলে তাদের গতির নির্ধারণ এবং প্রামানিকতার কোন নিয়ন্ত্রণই থাকবে না আমাদের হাতে। এটা দেখার পর এপিকিউরাস এই প্রামানিকতা থেকে পালানোর একটা অজুহাত বের করেন, যে অজুহাতটি ডেমোক্রিটাসের অবধান থেকে এড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন যে, ওজন এবং কারণে নিম্নমুখে ধাবিত হলেও পরমাণু খুব সামান্য চ্যুতি ঘটায়। তিনি যা চান, তা সমর্থনে অপারগতার চেয়ে এই মতামতকে দৃঢ়ভাবে বলা আরও বেশি অবমাননাকর।ঞ্চ
পিয়েরে বেইল একই ধরণের মত প্রকাশ করেন :
জ্ঞএপিকিউরাসের আগে পরমাণুর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওজনের গতি এবং প্রতিফলনের গতি স্বীকার করা হত.......... এপিকিউরাস ধারণা করেন যে, এমনকি শূন্যের কেন্দ্রেও সরলরেখা থেকে পরমাণুর সামান্য ক্ষয় হয় এবং এ থেকে তিনি বলেন, জ্ঞজ্ঞউত্থিত হয় মুক্তি.......ঞ্চঞ্চ আলোচনা প্রসঙ্গে এটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয় যা তাকে এই ক্ষয়ের গতি উদ্ভাবনের জন্য এগিয়ে নেয়। তিনি এটাকে পরমাণুর সংঘর্ষের ব্যাখ্যা দিতেও ব্যবহার করেছেন। কারণ এটা পরিষ্কারভাবেই দেখেছিলেন যে, সরলরেখা বরাবর একই সমান গতিতে নিম্নমুখে তাদের পতন] ধরে নিলে, তাদের মিলিত হবার ঘটনাকে কখনোই ব্যাখ্যা করা যাবে না। এবং এভাবে জগতে সৃষ্টি অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। তখন, এটা প্রামানিক ছিল যে, তারা সরলরেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে আসবে।ঞ্চ
আপাততঃ এই সব প্রতিফলনের বৈধতাকে খোলা প্রশ্ন হিসেবে রাখতে চাই। আলোচনা প্রসঙ্গে এটা সবার মনে রাখতে হবে যে, এপিকিউরাসের সাম্প্রতিকতম সমালোচক শ্‌বাখ্‌ কিকোরোকে ভুল বুঝেছিলেন, যখন তিনি বলেন :
জ্ঞপরমাণুসমূহ সবগুলোই পদার্থগত কারণবশতঃ আকর্ষণে নিম্নমুখে সমান্তরালে ধাবিত হতে বাধ্য হয়। কিন্তু পারস্পরিক বিকর্ষণের মধ্য দিয়ে তারা আরেকটি গতি লাভ করে, যা কিকেরো অনুসারে আকস্মিক কারণে এবং প্রকৃতপক্ষে অনন্তকাল থেকে একটি বক্রগতি।ঞ্চ
প্রথমে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটিতে কিকেরো বক্রদিকের কারণ হিসেবে বিকর্ষণকে দেখান নি। তিনি বরং বক্রদিককে বিকর্ষণের কারণ হিসেবে দেখান। দ্বিতীয়তঃ তিনি আকস্মিক কারণের ব্যাপারে কিছু বলেন না। বরং সমালোচনা করেন যে, কোন কারণই সামান্যতমও উল্লেখিত হয়নি। নিজের মধ্যে ও নিজের জন্য বিকর্ষণ এবং একই সময়ে আকস্মিক কারণ বক্রদিকের কারণ, এ দুটি স্বীকৃতি পরস্পরবিরোধী হতে পারে। তখন যে কেউ খুব বেশি হলে বিকর্ষণের আকস্মিক কারণগুলো বলতে পারতো; কিন্তু বক্রদিকের (জন্য দায়ী) আকস্মিক কারণগুলো সম্পর্কে নয়।
যা বাকি রইলো তার জন্য কিকেরো এবং বেইলের প্রতিফলনে একটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, যা এত সুস্পষ্ট যে, তা দ্রুত প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। তারা অন্যায়ভাবে এপিকিউরাসের উদ্দেশ্যের উপর গোপনে হস্তক্ষেপ করে, যার মাধ্যমে এদের একটি অন্যটিকে খারিজ করে দেয়। মনে করা হয় যে, এপিকিউরাস একদিকে বিকর্ষণ এবং আরেকদিকে মুক্তির ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য পরমাণুর ক্ষয়কে স্বীকার করে নেবেন। কিন্তু যদি পরমাণুসমূহ ক্ষয় ছাড়া মিলিত হয়, তাহলে মুক্তির ব্যাখ্যা হিসেবে ক্ষয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে যায়। মুক্তির বৈপরিত্য শুরু হয় শুধুমাত্র পরমাণুর নির্ধারিত এবং গতিশীল মিলনের মধ্য দিয়ে যেমনটি আমরা লুক্রেটিয়াসে দেখি। কিন্তু পরমাণুসমূহ ক্ষয় ছাড়া মিলিত হলে বিকর্ষণের ব্যাখ্যার জন্য তা বাতুলতা হত। আমি মনে করি যে, যখন সরলরেখা হতে পরমাণুর ক্ষয়কে ভাসা-ভাসা এবং সংযোগ বিচ্ছিন্নভাবে বোঝা হয়; যেমন হয়েছিল কিকেরো এবং বেইলের ক্ষেত্রে; তখন এই দ্বন্দ্ব উত্থিত হয়। সকল প্রাচীনদের মধ্যে লুক্রেটিয়াসকেই আমরা পাই যিনি বুঝেছিলেন যে এপিকিউরাসের পদার্থবিদ্যা আরো গভীর এক উপস্থাপন।
এখন আমরা স্বয়ং ক্ষয়কেই খতিয়ে দেখবো।
যেভাবে বিন্দু রেখাতে অস্বীকৃত হয়েছে, তাও অস্বীকৃত হয়ে যায়। এর বিশেষগুণ এখানে কোন ব্যাপারই নয়। পতনোন্মুখ আপেল একটি উল্লম্ব রেখার বর্ণনা করে; ঠিক যেমনটি একটি লোহার টুকরোও করে। পতনের গতি সম্পর্কে যতদূর পর্যন্ত আমাদের জানা আছে, তাতে, প্রত্যেকেই তাই চলমান বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাহীন বিন্দু, বর্ণনা অনুসারে যা সরলরেখার পূর্বশর্ত, এর ব্যক্তিত্বকে আত্ম-সমর্পন করে। তাই এরিস্টটলই সঠিক, যখন তিনি পিথাগোরিয়দের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান : তোমরা বল যে, রৈখিক গতি হচ্ছে ঐ রেখার বিন্দুর উপরিতল; তাহলে মোনাড গুলোর গতিও রৈখিক হবে। তাই মোনাড এবং পরমাণুগুলোও এর ফলাফল হিসেবে ধ্রুব গতিতেই থাকবে; যার মানে মোনাড অথবা পরমাণু কোনটিই অস্তিত্বমান নয়, বরং সরলরেখায় অদৃশ্য। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত এটা সরলরেখায় পতনশীল কিছু একটা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরমাণুর নিরেটত্ব এমনকি দৃশ্যপটেও আবির্ভূত হয় না। প্রথমত, শূন্যকে যদি জ্ঞস্থান সংক্রান্ত শূন্যঞ্চ হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে স্থানিক বিন্দুর ক্ষেত্র হতে নিকটবর্তী অমূর্ত স্থানের অস্বীকার করা হবে। ঘনত্ব, গাঢ়ত্ব, যা স্থানের অসঙ্গতি থেকে নিজকে নিজে রক্ষা করে, তা শুধুমাত্র একটি নীতির গুণে সংযুক্ত হতে পারে। এই নীতিটি বাস্তব প্রকৃতিতে সময়ের মতো একটি নীতি, যা সমগ্র ক্ষেত্রে স্থানকে অস্বীকার করে। উপরন্তু এটা যদি স্বয়ং নিজেকে স্বীকার না করে, তাহলে পরমাণু যতদূর পর্যন্ত সরলরেখায় গতিশীল, ততদূর পর্যন্ত স্থান দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং আপেক্ষিক সত্তা এবং খাঁটি বস্তুগত অস্তিত্বের কথা বলে। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, পরমাণুর ধারণার একটা মুহূর্ত খাঁটি আকৃতি লাভ করতে গিয়ে সকল আপেক্ষিকতা, অন্য ধারার সত্তার সাথে সম্পর্ককে অস্বীকার করে। একই সময়ে আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি যে, এপিকিউরাস উভয় মুহূর্তকে নিজে বিষয়গত করেন; যে মুহূর্ত দুঞ্চটো পরস্পর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সহজাতভাবেই পরমাণুর ধারণায় বিদ্যমান থাকে।
তারপরও এপিকিউরাস কিভাবে অন্য কোন সত্তা দ্বারা নির্ধারিত সত্তার যে কোন ধারার অস্বীকার করে পরমাণুর খাঁটি আকৃতি নির্ভুলভাবে নির্ধারণের এবং পরম স্বাতন্ত্র্যের ধারণার বাস্তবিকতা প্রদান করতে পারেন?
প্রত্যক্ষ সত্তার ক্ষেত্রে বিচরণ করার কারণে তাঁর সকল নির্ধারণই প্রত্যক্ষ। বিপরীত নির্ধারণ তাই প্রত্যক্ষ বাস্তবতা হিসেবে পরস্পর বিরোধী।
কিন্তু পরমাণুর মুখোমুখি হওয়া আপেক্ষিক অস্তিত্ব, সত্তার যে প্রকাশের ধরণকে অস্বীকার করতে হবে তা- হল সরলরেখা। এই গতির প্রত্যক্ষ অস্বীকার হচ্ছে আরেকটি গতি। সে কারণে স্থান সম্পর্কে যা ধারণাকৃত, তা হচ্ছে সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয়।
পরমাণু হচ্ছে নিখুঁতভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেহ অথবা বরং পরম স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ধারণাকৃত দেহ, অনেকটা গ্রহ-নক্ষত্রের মতো। এ অনুসারে, আবার তাদের বিচরণ গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বক্ররেখায়, সরলরেখায় নয়। ত্রুটির গতি হচ্ছে অ-সম্পূর্ণতার গতি।
তাই এপিকিউরাস সরলরেখা বরাবর পরমাণুর গতির সাপেক্ষে জড়তাকে উপস্থাপন করে সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয়ে এর নির্ভুল আকৃতি নির্ধারণের বাস্তবতা প্রদান করেছেন। এবং এই বিরুদ্ধ নির্ধারণগুলো উপস্থাপিত হয়েছে সরাসরি বিরুদ্ধ গতি হিসেবে।
লুক্রেটিয়াস তাই সঠিক, যখন তিনি মনে করেন যে, ক্ষয় চরম দশার বন্ধন ভেঙে দেয়। এবং যেহেতু তিনি এটাকে প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যে প্রয়োগ করেন, তখন পরমাণুর ক্ষেত্রে এটা বলাই যায় যে, ক্ষয় হচ্ছে এর মাঝের এমন কিছু একটা যা ঘুরে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ করতে পারে।
কিন্তু কিকেরো এপিকিউরাসকে এই বলে তিরস্কার করেন :
জ্ঞযার জন্য তিনি এত কিছু করেছেন, তিনি তার লক্ষ্যেরও নাগাল পাননি। কারণ, যদি সব পরমাণু ক্ষয় হয় তাদের কেউই কখনো একত্রিত হতে পারবে না, অন্যরা তাদের গতির কারণে সরল পথে চলতে থাকবে। সুতরাং এটা প্রামানিক হবে যে, পরমাণুগুলোর কাজের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হবে, যারা অবশ্যই সামনের দিকে সরলভাবে এবং বক্রভাবে চলবে।ঞ্চ
এই আপত্তিটির ন্যায্যতা এই যে, পরমাণুর ধারণায় যে দুঞ্চটি মুহূর্ত সহজাত, তা সরাসরি ভিন্ন ভিন্ন গতির মতো উপস্থাপিত হয়েছে। এবং সে কারণে ভিন্ন ভিন্ন স্বাতন্ত্র্যের কাছে একটি অসঙ্গতি বন্টিত হবে। কিন্তু তা সুসংহত হওয়ার কথা; যেহেতু পরমাণুর চারপাশ প্রত্যক্ষ।
এপিকিউরাস বেশ ভালোভাবে এই দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করেন। সে কারণে তিনি এই ক্ষয়টিকে সংবেদনের কাছে সম্ভাব্য অপ্রত্যক্ষ সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন; এটা জায়গা নেয়
জ্ঞঅনির্দিষ্ট স্থানে, কালেঞ্চ (লুক্রেটিয়াস, ঈন ক্ষনক্ষয়ল শতঢ়য়ক্ষন)
এটা সম্ভাব্য ক্ষুদ্রতম স্থানে সংগঠিত হয়।
উপরন্তু কিকেরো ও প্লুটার্ক অনুযায়ী বললে, কয়েকজন প্রাচীন লেখক এপিকিউরাসকে তিরস্কার করেন। কারণ তিনি বলেন যে, পরমাণুর ক্ষয় কোন কারণ ছাড়াই ঘটে। কিকেরো বলেন একজন পদার্থবিদের কাছে এর চেয়ে অসম্মানের আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রে কিকেরো যেমনটি চেয়েছিলেন সে অনুসারে একটি দৈহিক কারণ পরমাণুর ক্ষয়কে নির্ধারণবাদের পরিধির দিকে ফেরত পাঠাবে। এবং তারপর, ক্ষয়ের নির্ধারণের কাছে সমর্পিত হবার আগে কোনভাবেই সম্পূর্ণ হয় না। সে কারণে ক্ষয়ের এই কারণ খোঁজা হচ্ছে এমন একটি কারণ খোঁজা, যা পরমাণুকে নীতি হিসেবে তৈরী করে। পরিষ্কারভাবেই এটি অর্থহীন এক খোঁজ। সে কারণে পরমাণুই হচ্ছে আর সবকিছুর কারণ; যেখানে সে নিজেই কোন কারণ নয়।
অগাস্টিন-এর কর্তৃত্ব দ্বারা সমর্থিত বেইল মনে করতেন, ডেমোক্রিটাস পরমাণুতে মরমী নীতি, একটি কর্তৃত্ব আরোপ করেছেন। তবে তাঁর মতে, এরিস্টটল ও অন্যান্য প্রাচীনদের চাইতে ডেমোক্রিটাস অতটা গুরুত্বপূর্ণ নন। এই মরমী নীতির পরিবর্তে ক্ষয়ের ধারণা নিয়ে চিন্তা করার জন্য বেইল এপিকিউরাসের তিরস্কার করেন। তবে এতে অন্ততঃ জ্ঞপরমাণুর আত্মাঞ্চ নামে একটি শব্দ পাওয়ার লাভ হয়, যেখানে ক্ষয় প্রতিনিধিত্ব করে পরমাণুর প্রকৃত আত্মার, যা অমূর্ত স্বতন্ত্রতার সংঞ্চা।
সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয়ের ফলাফল বিবেচনা করার আগে আমাদের অবশ্যই আরেকটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এবং এই উপাদানটিকে এখন পর্যন্ত একদম উপেক্ষা করা হয়েছে।
সরলরেখা থেকে পরমাণুর ক্ষয় এপিকিউরিয় পদার্থবিদ্যায় আকস্মিকভাবে আবির্ভূত নির্দিষ্ট নির্ধারণের মতো নয়। বরং অপরদিকে, এটা যে সূত্র প্রকাশ করে তা সমগ্র এপিকিউরিয় দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। আর তা পাওয়া যায় এমন ভাবে যে, এর প্রতিভাসের নির্ধারণ নির্ভর করে এর ফলিত সীমানায়।
বাস্তবিকভাবে, অমূর্ত স্বতন্ত্রতা এর ধারণা তৈরী করতে পারে। এর আঙ্গিক-নির্ধারণ, পরম নিজের জন্য সত্তা, অপ্রত্যক্ষ সত্তা হতে এর নির্ভরহীনতা, সমস্ত আপেক্ষিকতার নেতিকরণ কার্যকর হয় কেবলমাত্র যে সত্তা এগুলোর মুখোমুখি হয়, সে সত্তা হতে অমূর্তকরণের দ্বারা। কারণ প্রকৃতভাবে একে অতিক্রম করতে অমূর্ত স্বতন্ত্রঞ্চর একে ভাবায়িত করতে হয়, আর তা কেবল সাধারণতায় করা যেতে পারে।
এভাবে যখন পরমাণু তার আপেক্ষিক অস্তিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে, সরলরেখা তার থেকে অমূর্ত ও বিচ্যুত হয়; তেমনি সমগ্র এপিকিউরিয় দর্শন সত্তার সীমায়িত ধারা থেকে তখনই বিচ্যুত হয়ে যায়, যখনই আত্ম-পর্যাপ্ততা এবং অন্যান্য সকল সত্তার সাথে অমূর্ত স্বতন্ত্রতার সকল সম্পর্কের নেতিকরণ এর ধারণা এর অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করে।
এভাবে ক্রিয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ব্যথা এবং বিভ্রান্তি থেকে বিচ্যুত অমূর্ততায় এবং প্রশান্তিতে, যেহেতু শুভ হচ্ছে অশুভ থেকে নিষ্কৃতি, আনন্দ হচ্ছে যন্ত্রণা থেকে দূরে সরে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত যেখানে অমূর্ত স্বতন্ত্রতা প্রতিভাসিত হয় তার সর্বোচ্চ মুক্তি এবং স্বাধীনতা নিয়ে, তার সমগ্রতায়, সেখানে বোঝা যায়- যে সত্তাটি দূরে সরে যায় তা হচ্ছে সর্ব সত্তা। সে কারণে দেবতারা জগত থেকে দূরে সরে গিয়ে তা নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে বাইরেই থাকেন।
এপিকিউরাসের এই দেবতাদের প্রায়শই পরিহাস করা হয়েছে। এই জ্ঞমানুষদের মতোঞ্চ দেবতারা বাস করতেন বাস্তব জগতের ইন্টার মুন্ডিয়া [জগতগুলোর মধ্যবর্তী স্থান] মধ্যে। তাঁদের দেহ ছিল প্রায় অদৃশ্য; রক্ত ছিল প্রায় অদৃশ্য রক্ত। তাঁরা পরম সুখ-শান্তির মধ্যে বাস করতেন; যে কোন বিনীত প্রার্থনাতেও কান দিতেন না। তাঁরা আমাদের এবং জগতের সাথে সম্পর্কহীন ছিলেন। তাঁদেরকে তাঁদের সৌন্দর্য, মহানুভবতা এবং তাঁদের উর্ধ্বতন প্রকৃতির জন্য সম্মান করা হয়; কোন লাভের জন্য নয়।
এই দেবতারা এপিকিউরাসের উদ্ভাবিত কল্প-কাহিনী নন। তাঁদের আসলেও অস্তিত্ব ছিল। তাঁরা হচ্ছেন গ্রীক কলার পরিবর্ধিত দেবতা। রোমান কিকেরো তাঁদেরকে উপহাস করতেন। কিন্তু প্লুটার্ক (যিনি ছিলেন গ্রীক), সমস্ত গ্রীক দৃষ্টিকোণ ভুলে বিস্মৃত হন যখন তিনি দাবি করেন- যদিও এই দেবতাদের তত্ত্ব ভয় এবং কু-সংস্কারের কারণে টিকে আছে, তাহলেও এটা দেবতাদের উৎফুল্ল করে না। তবে তার সাথে গড়ে উঠে বাস্তুভূতের সম্পর্ক- যাতে লাভও নেই, ক্ষতিও নেই। তাত্ত্বিক সৌম্যতা গ্রীক দেবতাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরিস্টটল বলেন :
জ্ঞযা সবচেয়ে ভালো, তার কোন ক্রিয়ার প্রয়োজন নেই; কারণ এটাই এর (নিজের) লক্ষ্য।ঞ্চ
আমরা এখন পরমাণুর ক্ষয়ের সরাসরি ফলাফলটি বিবেচনা করব। এতে প্রকাশিত হয়েছে সকল গতি এবং সকল সম্পর্কতে পরমাণুর অস্বীকৃতি, যার মাধ্যমে অন্য একটি সত্তা দ্বারা এটি স্বতন্ত্র সত্তার ধারা হিসেবে নির্ধারিত হয়। এটা এমন একটি পদ্ধতিতে উপস্থাপিত হয় যে, পরমাণু বিপরীত সত্তাটির দ্বারা সার-সংক্ষেপিত হয় এবং সত্তাটি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এর মধ্যে আধিত বলতে গেলে অন্য কিছুর সাথে এর সব সম্পর্কের নেতিকরণকে অবশ্যই বাস্তবায়ন আর ইতিবাচকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা শুধুমাত্র তখনই হবে, যদি যে সত্তার সাথে তা নিজেকে যুক্ত করবে, তা সে নিজেকে ছাড়া অন্য কেউ না হয়; যেহেতু এটা স্বয়ং একটা পরমাণুর সমান, যেহেতু এটা অনেকগুলো পরমাণুর নির্ধারণ। অনেকগুলো পরমাণুর বিকর্ষণ সে কারণে লেক্স এতোমি বা পরমাণুর সূত্রঞ্চর প্রয়োজনীয় উপলব্ধি, লুক্রেটিয়াস পরমাণুর ক্ষয়কে তাই বলতেন। কিন্তু যেহেতু এখানে প্রতিটি নির্ধারণ একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেহেতু প্রাক্তনটির সাথে বিকর্ষণ তৃতীয় গতি হিসেবে সংযুক্ত হয়। তাই লুক্রেটিয়াসই সঠিক, যখন তিনি বলেন যে, যদি পরমাণুর ক্ষয় না হতো, তাহলে তাদের বিকর্ষণ বা তাদের সংঘর্ষ হতো না এবং এ জগত সৃষ্টি হতো না। পরমাণুগুলো নিজের একক বিষয় এবং শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত হতে পারে। বিশেষ পরিভাষায় বললে, তারা শুধু মিলিত হতে পারে এই সব পরমাণুগুলোর আপেক্ষিক অস্তিত্ব দ্বারা, তারা অন্য সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হলে তা নেতিবাচক হয়। এবং এই আপেক্ষিক অস্তিত্ব হচ্ছে, যেমনটি আমরা দেখি, তাদের মূল গতি সরলরেখায় তাদের পতনের গতি। যেহেতু তারা মিলিত হয় শুধুমাত্র সরলরেখা থেকে তাদের ক্ষয়ের গুণের কারণে, সেহেতু বস্তুর অংশকরণে এর কিছুই করার নেই।
বাস্তবে, প্রত্যক্ষভাবে বিরাজমান স্বতন্ত্রতা শুধুমাত্র ধারণাগতভাবে উপলব্ধি করা যায়, যতটা সে অন্য কিছুর সাথে সম্পৃক্ত হয়। আর সেই অন্য কিছু আসলে সে নিজেই, এমনকি যখন অন্য জিনিস প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের আঙ্গিকে এর মুখোমুখি দাঁড়ায়। এভাবে মানুষ তখনই আর প্রকৃতির উৎপাদন হিসেবে থাকে না, যখন যেসব অন্য সত্তার সাথে সে নিজেকে জড়ায় তারা তার ভিন্ন অস্তিত্ব নয়। বরং নিজেই একজন স্বতন্ত্র মানব সত্তা- এমনকি যদি তখনও তা মন না হয়ে উঠে তাহলেও। কিন্তু মানুষকে যেহেতু নিজেই নিজের প্রকৃত বিষয় হতে হবে, সেহেতু তাকে অবশ্যই তার মাঝের নিছক প্রকৃতি, তার বাসনা করা শক্তি, তার আপেক্ষিক অস্তিত্ব চূর্ণ করতে হবে। আত্ম- চৈতন্যের প্রথম ধরণ হচ্ছে বিকর্ষণ। এটা তাই ঐ আত্ম- চৈতন্যের সাথে সম্পৃক্ত, যা নিজেকে প্রত্যক্ষ সত্তা হিসেবে, অমূর্ত সত্তা হিসেবে ভাবে।
যতক্ষণ এটা অমূর্ত আঙ্গিক, কিন্তু একই সঙ্গে কোনভাবে কম বিপরীত নয়; যতক্ষণ এটা অমূর্ত বস্তু, যাতে সে নিজে সুস্থিতভাবে সম্পৃক্ত থাকে, পরমাণুর সাথে সত্যিকারের সম্পৃক্তি হিসেবে- তবে তা অন্য পরমাণু। তবে যখন আমি এমনভাবে নিজের সাথে নিজেকে যোগ করি যেন নিজে সরাসরি এমন কিছু যা অন্য কিছু, তাহলে আমার সম্পর্কটা একটা বস্তুগত সম্পর্ক। বাহ্যিকতার এমন চূড়ান্ততম স্তরই ধারণা করা যেতে পারে। তাই, পরমাণুগুলোর বিকর্ষণের মধ্যে তাদের বস্তুত্ব (যা একটি সরলরেখার উপর পতনের মধ্যে প্রদর্শিত, আঙ্গিক-নির্ধারণ, যা ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দুটি (বস্তুত্ব ও আকৃতি নির্ধারণ) সমন্বয়ীভাবে একতাবদ্ধ) প্রকাশিত হয়।
এপিকিউরাসের বিপরীতে ডেমোক্রিটাস একটি বাধ্য করা গতি এবং একটি অন্ধ অত্যাবশ্যকীয়তা তৈরী করেন, যা এপিকিউরাসের ক্ষেত্রে হল পরমাণুর ধারণার বাস্তবায়ন। ইতিপূর্বেই আমরা দেখেছি যে, তিনি পরমাণুগুলোর বিকর্ষণ ও সংঘর্ষের পূর্বে সৃষ্ট আবর্তকে প্রামানিকতার উপাদান বলে বিবেচনা করেন। তাই তিনি বিকর্ষণের মধ্যে শুধুমাত্র বস্তুগত দিক, টুকরো দিকটা, পরিবর্তনটা দেখেন। এ মতে, অন্য কিছুর সাথে সম্পর্ক নেতিকৃত হয় এবং গতি প্রতিষ্ঠিত হয় আত্ম-নির্ধারণ হিসেবে। এ থেকে এটা পরিষ্কারভাবে দেখা যেতে পারে যে, তিনি একটি এক এবং অভিন্ন দেহের ধারণা করেছিলেন যে দেহ ফাঁকা স্থানের মধ্যে স্বর্ণ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাবার মতো অনেক ভাগে বিভাজিত।
এভাবে তিনি পরমাণুর ধারণা হিসেবে একটি জ্ঞএকঞ্চ এর ধারণা ভালো করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
এরিস্টটল সঠিকভাবে তাঁর যুক্তি দেখিয়েছেন :
জ্ঞলিউসিপাস এবং ডেমোক্রিটাস দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে, প্রাথমিক দেহগুলো সর্বদা শূন্যে এবং অসীমের মধ্যে ঘুর্ণনরত। এটা কোন ধরণের গতি এবং তাঁদের কাছে প্রাকৃতিক গতি কি- তা তাঁদেরই বলার কথা। যদি উপাদানসমূহের প্রত্যেকটি অন্যটি দ্বারা বল প্রয়োগে চালিত হয়, তাহলেও এটা প্রামানিক যে, প্রত্যেকেরই একটা প্রাকৃতিক গতি থাকা উচিত, যার বাইরে আছে সেই বাধ্য করা গতি। আর এই প্রথম গতিটি কোন ভাবেই বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এটি প্রাকৃতিক। অন্যথায় এই কর্মপদ্ধতিটি অসীমের দিকে চলে যাবে।ঞ্চ
এভাবে, এপিকিউরাসের পরমাণুর ক্ষয় তত্ত্ব পরমাণুর পরিধির সমগ্র আন্তঃকাঠামো পরিবর্তন করে দেয়; যেহেতু এর মধ্য দিয়ে আঙ্গিক-নির্ধারণ বৈধ হয় এবং পরমাণুর ধারণার সহজাত দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করা যায়। তাই এপিকিউরাসই প্রথম বিকর্ষণের সারসত্তাকে- এমনকি সংবেদক আঙ্গিকে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন; যেখানে ডেমোক্রিটাস শুধু এর বস্তুগত অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেন।
এখান থেকে আমরা এপিকিউরাসের প্রয়োগ করা বিকর্ষণের আরও ঘনীভূত আঙ্গিক খুঁজে পাবো। সেখানে রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে আহ্বান আছে একত্রে মিলিত হবার, সামাজিক বলয়ের মধ্যে আহ্বান আছে বন্ধুত্বের। আর এটাই তো পরম শুভ।

পরবর্তী অংশ