Marxists Internet Archive
Bangla Section


জার্মান ভাবাদর্শ

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

৩. কমিউনিজম: খোদ মেলামেশার আঙ্গিকের উপাদান

আগের সব সঞ্চালন থেকে কমিউনিজম একটা দিক দিয়ে আলাদা। আর তা হল এই যে এটা আগের সব উৎপাদন সম্পর্ক আর মেলামেশাকে উল্টে দেয় আর প্রথমবারের মতো সব প্রাকৃতিক ক্ষেত্রগুলোকে সচেতনভাবে নাড়াচাড়া করে মানুষের সৃষ্টি হিসেবে, তাদেরকে তাদের স্বাভাবিক চরিত্র হতে আলগা করে সম্মিলিত স্বতন্ত্রদের বশীভূত করে। তাই এর সংগঠন আবশ্যিকভাবেই অর্থনৈতিক, এই সম্মিলনের শর্তের বস্তুগত উৎপাদন।এটা বহাল শর্তকে সম্মিলনের শর্তে পাল্টে দেয়। কমিউনিজম যে বাস্তবতা সৃষ্টি করছে তা মোদ্দা কথায়- স্বতন্ত্রদের থেকে মুক্তভাবে কোন কিছুর বহাল থাকাকে অসম্ভব করার বাস্তব ভিত্তি, যদ্দুর পর্যন্ত এসব জিনিস শুধুমাত্র স্বতন্ত্রদের নিজেদের পূর্বের মেলামেশার উৎপন্ন। এভাবে ব্যবহারিক কাজে কমিউনিস্টরা উৎপাদন এবং মেলামেশার দ্বারা সৃষ্ট শর্র্তকে অজৈব শর্ত হিসেবে নাড়াচাড়া করে। তবে তার জন্য তাকে এটা কল্পনা করতে হয় না যে আগের প্রজন্মের পরিকল্পনা বা নিয়তি ছিল এই মালমশলা যোগান দেয়া। অথবা এও বিশ্বাস করতে হয়না যে এই শর্তগুলো তাদের সৃষ্টি করণেওয়ালা স্বতন্ত্রদের কাছে অজৈব ছিল।
ব্যক্তি হিসেবে এবং যা তাদের কাছে আকস্মিকতার হিসেবে স্বতন্ত্রদের মাঝের পার্থক্য, তা ধারণাগত পার্থক্য নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বিভিন্নকালে এই পার্থক্য বিন্দুর ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল, যেমন অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি স্বতন্ত্রদের কাছে আকস্মিক একটি কিছু ছিল, কম বেশি পরিবারও। এই পার্থক্য বিন্দু প্রতিকালের জন্য আমাদের তৈরী করার মত নয়, বরং এই পার্থক্য প্রতিটি কাল নিজেই তৈরী করে তার বহাল পাওয়া বিভিন্ন উপাদানের মাঝ হতে। আর আসলেও তা কোন তত্ত্ব অনুসারে নয়, বরং জীবনের বস্তুগত সংঘাত দ্বারা বাধ্য হয়ে। পরবর্তী যুুগের হাতে তুলে দেয়া পূর্ববর্তী যুগের উপাদান (যা পরবর্তী যুগের কাছে আকস্মিক, তা পূর্ববর্তী যুগের বিপরীতে) একটি মেলামেশার আঙ্গিক যা উৎপাদনী শক্তির একটি কম বিকশিত দশার সাথে সম্পর্কিত। মেলামেশার আঙ্গিকের প্রতি উৎপাদনী শক্তিগুলোর সম্পর্ক হল স্বতন্ত্রদের পেশা বা কাজকর্মের প্রতি মেলামেশার আঙ্গিকের সম্পর্ক। (এই কাজকর্মের মৌলিক আঙ্গিক অবশ্যই বস্তুগত, যার মাঝ হতে নির্ভর করে বাকি সব আঙ্গিক- মানসিক, রাজনৈতিক, ধার্মিক ইত্যাদি। অবশ্যই বস্তুগত জীবনের বিভিন্ন আকার নেয়া, প্রত্যেক ক্ষেত্রে সেই দরকারের উপর নির্ভরশীল, যেগুলো ইতঃমধ্যে বিকশিত। এই দরকারগুলোর উৎপাদন এবং পরিতৃপ্তি উভয়ই একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা কোন ভেড়া বা কুকুরের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়না [ স্টার্নারের প্রধান যুক্তি মানুষের বিরুদ্ধের বিকৃতি ], যদিও ভেড়া আর কুকুর নিশ্চয়ই, ঐসব সত্ত্বেও একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার উৎপাদ)। যে শর্তের অধীনে স্বতন্ত্রেরা পরস্পর মেলামেশা করে (যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্বোদ্ধৃত ঠোকাঠুকি অনুপস্থিত) সেই শর্তগুলো তাদের স্বতন্ত্রতার অংশ, কোনভাবেই তাদের কাছে বাহ্যিক নয়। কেবল এ শর্তগুলোর অধীনেই এই নির্দিষ্ট সম্পর্কের অধীনে বেঁচে থাকা নির্দিষ্ট স্বতন্ত্রেরা তাদের বস্তুগত জীবন আর এর সাথে সংযুক্তগুলো উৎপাদন করতে পারে; আর এভাবে এগুলো তাদের আত্ম-ক্রিয়ার শর্ত আর এই আত্ম-ক্রিয়া দ্বারাই উৎপাদিত। যে নির্দিষ্ট শর্তগুলোর অধীনে তারা উৎপাদন করে সেগুলো এভাবে সম্পৃক্ত (যতক্ষণ পর্যন্ত ঠোকাঠুকি আবির্ভূত না হচ্ছে) তাদের শর্তায়িত স্বভাবের বাস্তবতার সাথে, তাদের একপেশে অস্তিত্বের সাথে। এর একপেশেপনা কেবল তখনই পষ্ট হয় যখন দৃশ্যপটে ঠোকাঠুকি বহাল থাকে। তখন এই শর্তগুলো আবির্ভূত হয় যে এই শেকল আগের যুগেও আরোপ হয়েছিল।
এই বহুশর্ত প্রথমে আত্ম-ক্রিয়ার শর্ত, পরে তা এর উপর শেকল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই বহুশর্ত গড়ে উঠে ইতিহাসের পুরো বিবর্তনে যা মেলামেশার আঙ্গিকের জোড় লাগা ধারাক্রম। এই জোড় লাগা যাতে গঠিত তা হচ্ছে : পূর্বতন মেলামেশার যে আঙ্গিক শেকলে পরিণত হয়ে গেছে তার জায়গায় নতুন আঙ্গিক স্থাপিত হওয়ায়, যে আঙ্গিক আরো বিকশিত উৎপাদনী শক্তির সাথে সম্পৃক্ত আর তাই স্বতন্ত্রের আত্ম-ক্রিয়ার অগ্রসর ধরণের সাথে যুক্ত- এই আঙ্গিক নিজের বেলায় আবার শেকল হয়ে পড়ে আর আরেকটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। যেহেতু এই শর্তগুলো প্রতিটি দশায় উৎপাদনী শক্তির যুগপৎ বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত, তাদের ইতিহাস একই কালে প্রত্যেক নতুন প্রজন্মের গ্রহণ করা বিকাশমান উৎপাদনী শক্তির ইতিহাস; এবং তাই তা স্বতন্ত্রদের নিজেদের শক্তির বিকাশের ইতিহাস।
যেহেতু এই বিবর্তন ঘটে স্বাভাবিকভাবে (যার মানে কোন মুক্তভাবে একত্রিত স্বতন্ত্রদের সাধারণ পরিকল্পনার অধীন না থাকা.), এটি যাত্রা করে বিভিন্ন লোকালয়, গোত্র, জাতি, শ্রমের শাখা ইত্যাদি হতে, যাদের প্রত্যেককে অন্যের থেকে স্বাধীনভাবে আরম্ভ করতে হয় আর কেবল ক্রমান্বয়ে অন্যের সাথে সম্পর্কে প্রবেশ করে। তদুপরি, এটি সংগঠিত হয় কেবল খুব ধীরে; বিভিন্ন দশা ও স্বার্থ কখনোই পুরোপুরি অতিক্রম করা যায় না, তা কেবল বিজয়ীর স্বার্থের অধীন হয়ে যায়; আর বহু শতক এর স্বার্থের পেছন পেছন চলে। এ থেকে বোঝা যায় যে একটা জাতির নিজের ভেতরেই স্বতন্ত্রের এমনকি তাদের আর্থিক অবস্থার বাদেও, একদম ভিন্ন বিকাশ আছে। আর একটি পূর্বতন স্বার্থ, মেলামেশার একটা বিচিত্র আঙ্গিক, যা ইতঃমধ্যেই বর্জিত হয়ে গেছে পরিবর্তী স্বার্থ অধিকারীর হওয়ার কারণে তা পরে দীর্ঘকালের জন্য রয়ে যায় মায়া সম্প্রদায়ের (রাষ্ট্র, আইন) ঐতিহ্যগত ক্ষমতার দখলে। তা স্বতন্ত্রদের থেকে মুক্ত হয়ে একটি অস্তিত্ব জিতে নিয়েছে; তা এমন একটি শক্তি যা শেষ ভরসায় একটি বিপ্লব দিয়েই ভাঙা যায়। আরো সাধারণ বিচার অনুমোদন করা স্বতন্ত্র বিন্দুর সাপেক্ষে এটা ব্যাখ্যা করে যে কেন চৈতন্য মাঝে মাঝে সমসাময়িক অভিঞ্চতাগত সম্পর্কের চাইতে বেশি অগ্রসর মনে হয়, যাতে পরবর্তী কাল পর্বের সংগ্রামে কেউ পূর্বতন তাত্ত্বিকদের উপরওয়ালা হিসেবে বরাত দিতে পারেন।
অপরদিকে উত্তর আমেরিকার মত যেসব দেশ শুরু হয় ইতঃমধ্যে অগ্রসর কালপর্বে, তাদের বিকাশ এগোয় খুব দ্রুত। এমন দেশগুলোর স্বতন্ত্রদের ছাড়া আর কোন স্বাভাবিক প্রাকসিদ্ধান্ত নেই। এই স্বতন্ত্রেরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল, আর তা করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ প্রাক্তন দেশের মেলামেশার আঙ্গিক তাদের প্রয়োজনের সাথে তাল মেলাতে পারছিল না। এভাবে ঐ দেশগুলো যাত্রা করে প্রাক্তন দেশের সবচাইতে প্রাগ্রসর স্বতন্ত্রদের সাথে, আর তাই তা সম্পৃক্তভাবে সবচাইতে অগ্রসর মেলামেশার আঙ্গিক, এই মেলামেশার আঙ্গিক নিজেকে পুরনো দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার আগে।* সামরিক বা বাণিজ্য ঘাঁটি না হলে সব উপনিবেশের ক্ষেত্রে এ-ই ঘটে। কার্থেজ, গ্রীক উপনিবেশ, একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীর আইসল্যান্ড এর উদাহরণ। বিজয় অভিযান থেকেও একই ঘটনা উদ্ভূত হয়, যখন অন্য মাটিতে বিকশিত হওয়া মেলামেশা বিজিত দেশে পুরোপুরি তুলে আনা হয় : যেখানে এর নিজের দেশে এটি তখনো আগের কালের ফেলে যাওয়া স্বার্থ ও সম্পর্ক দ্বারা বিঘ্নিত, তখন উপনিবেশে এটাকে কোন ঝামেলা ছাড়া পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং অবশ্যই হয়ও, যদি কেবল বিজয়ীদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতাও নিশ্চিত করতে হয়। (নর্মান বিজয়ের পর ইংল্যান্ড ও নেপলস্‌, যখন তারা সামন্ত সংগঠনের সবচাইতে নিখুঁত আঙ্গিক গ্রহণ করে।)
আমাদের দৃষ্টি অনুসারে এভাবে ইতিহাসে সমস্ত ঘাত প্রতিঘাত এর উৎস আছে উৎপাদনী শক্তির এবং মেলামেশার আঙ্গিকের ঠোকাঠুকিতে। কিন্তু একই সাথে- কোন দেশের ঘাত প্রতিঘাতে পৌঁছতে হলে, ঠোকাঠুকি ঐ দেশেরই চূড়ায় উঠে আসতে হবে এমন কোন কথা নেই। আন্তর্জাতিক মেলামেশার বিস্তৃতির মাঝে উঠে আসা শিল্পে বেশি অগ্রসর দেশগুলোর মাঝে প্রতিযোগিতা, পিছিয়ে পড়া শিল্পের দেশে একই রকম ঠোকাঠুকি উৎপাদন করার জন্য যথেষ্ট (যেমন, জার্মানীর চোখে না পড়া প্রলেতারিয়েতরা ইংলিশ শিল্পের প্রতিযোগিতা দ্বারা দৃশ্যপটে আসে)।
উৎপাদনী শক্তি আর মেলামেশার আঙ্গিকের এই ঠোকাঠুকি, আমরা যেমন দেখি, অতীত ইতিহাসে বেশ কঞ্চবারই ঘটেছে, এর ভিত্তিকে বিপদগ্রস্ত না করে। এই ঠোকাঠুকি প্রত্যেকবারই প্রামাণিকরূপে একট বিপ্লব হিসেবে বিস্ফোরিত হয়েছে, একইসাথে নানা সহ-আঙ্গিক নিয়ে, যেমন- সর্বগ্রাসী ঘাত প্রতিঘাত, বিভিন্ন শ্রেণীর ঘাত-প্রতিঘাত, চৈতন্যের ঠোকাঠুকি, ভাবনার যুদ্ধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। সংকীর্ণ দৃষ্টি বিন্দু হতে কেউ এই আনুষঙ্গিক আঙ্গিকগুলোর একটাকে বিচ্ছিন্ন করে ঐ আলগা আঙ্গিকটাকেই এই সব বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। বিপ্লব আরম্ভ করা স্বতন্ত্রেরা তাদের সংস্কৃতির মাত্রা আর ঐতিহাসিক বিকাশের দশা অনুযায়ী নিজেদের কাজকর্ম নিয়েই মায়া তৈরী করে বলে কাজটা আরো সহজ।
শ্রম বিভাগের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ক্ষমতার (সম্পর্কের) বস্তুগত ক্ষমতায় রূপান্তর, কারুর মন থেকে এর সাধারণ ধারণা খারিজ করেই অদৃশ্য করা যাবে না। বরং তা করতে হবে এই বস্তুগত ক্ষমতা স্বতন্ত্রদের আবার নিজেদের অধীন করে আর শ্রম বিভাগ নিশ্চিহ্ন করার স্বতন্ত্রদের যে ক্রিয়া তার দ্বারা। জনসম্প্রদায় ছাড়া তা সম্ভব না। শুধুমাত্র জনসম্প্রদায়েই অন্যদের সাথে সাথে স্বতন্ত্রদের তার মেধাকে সবদিকে খাটানোর সুবিধা থাকে; আর তাই শুধুমাত্র জনসম্প্রদায়েই ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্ভব। জনসম্প্রদায়ের জন্য আগের বিকল্পগুলোতে, রাষ্ট্র ইত্যাদিতে স্বাধীনতা বহাল ছিল শুধু সেই স্বতন্ত্রদের জন্য যারা শাসক শ্রেণীর সম্পর্কের মাঝে বিকশিত হয়েছে; আর সেই স্বাধীনতা এই শ্রেণীর স্বতন্ত্র হওয়া পর্যন্তই। এখন পর্যন্ত যে মায়া জনসম্প্রদায়ে স্বতন্ত্রেরা একত্রিত হয়েছে, সে জনসম্প্রদায় স্বতন্ত্রদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বদাই একটি মুক্ত অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। যেহেতু এটি ছিল এক শ্রেণীর বিরুদ্ধে অন্য শ্রেণীর সমন্বয়ে গঠিত, সেহেতু তা শুধূ পুরোপুরি মায়া জনসম্প্রদায়ই ছিল না একই সাথে ছিল একটি নতুন শেকলও। বাস্তব জনসম্প্রদায়ে স্বতন্ত্ররা তাদের স্বাধীনতা পায় তাদের সংঘকরণের মাঝে ও ভিতর দিয়ে।
এখন পর্যন্ত আমরা যা বলছি তা থেকে বোঝা যায় যে সম্প্রদায়গত সম্পর্ক (যাতে একটি শ্রেণীর স্বতন্ত্র প্রবেশ করে আর যা কোন তৃতীয় পক্ষের বিপক্ষে তাদের সাধারণ স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত) সবসময়ই ছিল এমন একটা জনসম্প্রদায় যাতে এই স্বতন্ত্রেরা কেবল গড়পড়তা স্বতন্ত্র হিসেবেই থাকত, তাও ততদূর পর্যন্তই যতদূর তারা তাদের শ্রেণীর অস্তিত্বের আওতায় থাকতো। এই সম্পর্কে তারা স্বতন্ত্র নয় বরং শ্রেণীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করতো। প্রলেতারিয় বিপ্লবী সম্প্রদায় তাদের অস্তিত্বের শর্ত এবং সমাজের সব সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। এখানে স্বতন্ত্রেরা স্বতন্ত্র হিসেবেই অংশগ্রহণ করে। স্বতন্ত্রদের ঠিক এই সমাবেশই (অবশ্যই আধুনিক উৎপাদনী শক্তির অগ্রসর দশা ধারণা করে) স্বতন্ত্রদের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্ত বিকাশ ও সঞ্চালনের শর্ত প্রদান করে। এই শর্তগুলোই আগে সুযোগের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল আর তা আলাদা স্বতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীন অস্তিত্ব জিতে নিয়েছিল শুধুমাত্র তাদের স্বতন্ত্র হিসেবে আলাদা হবার আর তাদের সমাবেশ শ্রম বিভাগ দ্বারা নির্ধারিত হবার কারণে এবং তাদের ছাড়াছাড়িটা তাদের কাছে বিজাতীয় বন্ধন হয়ে পড়ার মাধ্যমে। সমাবেশ এখন পর্যন্ত (সোশাল কনট্রাক্‌ট্‌(৪১) এ যেমন বলা হয়েছে কোনমতেই সে রকম স্বেচ্ছাচারী নয়, বরং প্রামাণিকভাবে) শুধু এই শর্তগুলোতেই অনুমোদিত ছিল, যার মাঝে স্বতন্ত্রেরা সুযোগের অনুগ্রহে ছিল (তুলনা: যেমন উত্তর আমেরিকান রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রজাতন্ত্রগুলোর গঠন)। নির্দিষ্ট শর্তে এই অবিঘ্নিত উপভোগের অধিকার, আকস্মিক ভালো কিছু ঘটে যাওয়া এবং সুযোগকেই এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলা হচ্ছে : কিন্তু এই শর্তগুলো অবশ্যই নিছক কোন নির্দিষ্ট কালে উৎপাদনী শক্তি এবং মেলামেশার আঙ্গিক।
যদি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি ও শ্রেণীর অস্তিত্বের সাধারণ শর্তে স্বতন্ত্রদের বিবর্তন বিবেচনা করে (যা একে অপরকে অনুসরণ করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সাধারণ ধারণাগুলোসহ) তাহলে এটা কল্পনা করা নিশ্চয় খুব সহজ যে এই স্বতন্ত্রদের মাঝে প্রজাতি বা মানুষ বিকশিত হয়েছে, অথবা তারা মানুষ বিকশিত করে- আর এভাবে কেউ ইতিহাসের কানে বেশ করে তুলো গুঁজে দিতে পারে।*
নির্দিষ্ট শ্রেণীগুলোর নিচে স্বতন্ত্রদের এই চাপা পড়ে যাওয়া ততক্ষন নিশ্চিহ্ন করা যাবে না, যতক্ষণ না এমন এক শ্রেণী আকার নিচ্ছে- যার শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিবৃত করার মত আর বিশেষ শ্রেণী স্বার্থ নেই।
স্বতন্ত্রেরা সব সময়ই তৈরী করেছে নিজেদের উপর; কিন্তু তা স্বাভাবিকভাবে তাদের নিজেদের উপর তাদের প্রদত্ত ঐতিহাসিক শর্ত এবং সম্পর্কের মাঝে, ভাবাদর্শবাদীদের বোধে শুদ্ধ স্বতন্ত্রে নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথে আর শ্রমবিভাজনের মাঝে সামাজিক সম্পর্ক একটি স্বাধীন অস্তিত্ব পরিগ্রহ করে। মোদ্দা কথায় এই অনিবার্য ঘটনায় প্রত্যেক স্বতন্ত্রের জীবনের মাঝে একটি বিভাজন আবির্ভূত হয়, যদ্দুর পর্যন্ত তা ব্যক্তিগত আর যদ্দুর পর্যন্ত তা শ্রমের কোন শাখা এবং এতে ভুক্ত শর্ত দ্বারা নির্ধারিত। (এ থেকে আমরা বুঝতে বলছি না, যেমন, ভাড়াওয়ালা, পুঁজিপতি ইত্যাদি আর ব্যক্তি থাকেনা। বরং তাদের ব্যক্তিত্ব একেবারে নির্দিষ্ট শ্রেণী সম্পর্ক দিয়ে শর্তায়িত ও নির্ধারিত, আর এই বিভাজন আবির্ভূত হয় কেবল অন্য শ্রেণীর প্রতি তাদের বিরুদ্ধতায়, আর নিজেদের ক্ষেত্রে কেবল দেউলিয়া হলে পর।)
বৃহৎ ভূ-সম্পত্তিতে (গোত্রে আরো বেশি) তা যেন এখনো আবৃত : উদাহরণস্বরূপ একজন অভিজাত সবসময়ই অভিজাত, একজন সাধারণ সবসময়ই সাধারণ, তার অন্যান্য সম্পর্ক বাদ দিয়ে তার স্বতন্ত্রতা হতে অবিচ্ছেদ্য একটি গুণ। ব্যক্তি আর শ্রেণী স্বতন্ত্রের মাঝে বিভাজন, স্বতন্ত্রদের জন্য জীবনের শর্তসমূহের আকস্মিক স্বভাব কেবল শ্রেণীর উদ্ভবের সাথেই আবির্ভূত হয়; যা নিজেই বুর্জোয়াদের একটি উৎপাদ। এই আকস্মিক চরিত্রটি তৈরী ও বিকশিত হয় কেবল স্বতন্ত্রদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা আর সংঘাত দিয়ে। এভাবে কল্পনায় বুর্জোয়াদের অধীনে স্বতন্ত্রদের আগের চাইতে মুক্ততর বলে দেখা যায়, কারণ তাদের জীবন শর্ত আকস্মিক মনে হয়। সন্দেহ নেই যে বাস্তবে তারা আরো কম মুক্ত, কারণ তারা জিনিসের সন্ত্রাসের আরো বেশি অধীন। বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি হতে পার্থক্য বেরিয়ে আসে বিশেষ করে বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েতের বৈরী ভাবে। যখন শহুরে বার্ঘার, আইনী সংঘ ইত্যাদির বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি ভূ-মালিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে উদ্ভূত হয়, তাদের অস্তিত্বের শর্ত (অস্থাবর সম্পত্তি এবং ঘরোয়া শিল্পের শ্রম, যা ইতঃমধ্যে সামন্ত বন্ধন থেকে ছাড়াছাড়ি হবার আগে অদৃশ্যভাবে বহাল ছিল) ইতিবাচক কিছু হিসেবে আবির্ভূত হল, যা সামন্ত ভূ সম্পত্তির বিরুদ্ধে বিবৃত হয়; আর তাই এর নিজের পথে প্রথমে সামন্ত আঙ্গিকটা নেয়। শরণার্থী ভূমিদাসরা অবশ্যই তাদের প্রাক্তন দাসত্বকে তাদের ব্যক্তিত্বে আকস্মিক কিছু একটা বলে দেখতো। এখানে তারা শুধু তা-ই করছিল, শেকল থেকে মুক্ত হচ্ছে এমন প্রত্যেক শ্রেণী যা করে। এবং তারা নিজেদের জ্ঞশ্রেণীঞ্চ হিসেবে নয়, আলাদাভাবে মুক্ত করেছিল। তদুপরি, তারা বৃহৎ ভূ সম্পত্তি ব্যবস্থা থেকে উপরে ওঠেনি, বরং কেবল নতুন বৃহৎ ভূ সম্পত্তি গঠন করেছে; এমনকি নতুন পরিস্থিতিতেও পূর্বের শ্রম ধরণ আঁকড়ে রেখে একে আগের শেকল থেকে মুক্ত করে, যা ইতঃমধ্যে পৌঁছনো বিকাশের সাথে আর তাল মেলাতে পারছিলো না।*
অপরদিকে, প্রলেতারিয়েতদের জন্য তাদের অস্তিত্বের শর্ত, শ্রম এবং এর সাথে আধুনিক সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা সব অস্তিত্বের শর্তসমূহ আকস্মিক কিছু একটা হয়ে পড়ে; হয়ে পড়ে এমন কিছু যার ওপর তাদের আলাদা স্বতন্ত্র হিসেবে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, আর যার ওপর কোন সামাজিক সংগঠনই তাদের নিয়ন্ত্রণ দিতে পারে না। প্রত্যেক আলাদা প্রলেতারিয় স্বতন্ত্রতা এবং শ্রমের মাঝের ঠোকাঠুকি, তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া জীবনের শর্ত তার কাছে নিজেই প্রমাণমূলক হয়ে পড়ে। কারণ সে যৌবন থেকেই কোরবানী দেয়া। তার নিজের শ্রেণীর মাঝে তাকে অন্য শ্রেণীতে স্থাপন করার মত অবস্থায় আসার কোন সুযোগ নেই। এভাবে, যখন শরণার্থী ভূমিদাসেরা শুধুমাত্র বিকাশিত হতে আর ইতঃমধ্যে সেখানে বিদ্যমান শর্তগুলো বিবৃত করতে মুক্ত হতে চায় এবং তাই শেষে নিছক মুক্ত শ্রমে পৌঁছায়, তখন প্রলেতারিয়েতরা যদি তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র হিসেবে বিবৃত করতে চায় তাহলে এখন পর্যন্ত থাকা তাদের অস্তিত্বের শর্তটাই নিশ্চিহ্ন করতে হবে (সর্বোপরি বর্তমান পর্যন্ত সব সমাজে এটাই হয়ে এসেছে), নাম করতে গেলে জ্ঞজ্ঞশ্রমঞ্চঞ্চ। এভাবে তারা সরাসরি নিজেদের পায় ঐ আঙ্গিকটার বিপরীতে যে আঙ্গিকে এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্রেরা নিজেদের সমন্বিত প্রকাশ করেছে; যে আঙ্গিক হল রাষ্ট্র। তাই স্বতন্ত্র হিসেবে নিজেদের বিবৃত করতে তাদের অবশ্যই রাষ্ট্রকেই উৎখাত করতে হবে।

পরবর্তী অংশ