Marxists Internet Archive
Bangla Section


ডেমোক্রেটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

প্রথম অংশ: ডেমোক্রিটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের সাধারণ পার্থক্য

১. অভিসন্ধর্ভের বিষয়বস্তু :
একটি ট্রাজেডি যেমন ভালো উপসংহারে শেষ হয়, গ্রীক দর্শনে মনে হয় সেরকম কিছু হয়নি। ফলে এর সমাপ্তি হয়েছে নিস্প্রভ। গ্রীসে দর্শনের বস্তুগত ইতিহাস সম্ভবত এরিস্টটলের সাথেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ম্যাসেডনের আলেকজান্ডার, এমনকি জ্ঞসিংহ- বিক্রমীঞ্চ বৈরাগ্যবাদীদের গ্রীক দর্শনও সেক্ষেত্রে সফল হয় নি, স্পার্টানরা যা তাদের মন্দিরে বসেই সম্পন্ন করে গেছে। আর তা হচ্ছে এথেনাকে শৃঙ্খলিত করা, যাতে হেরাক্লিস পালাতে না পারে।
এপিকিউরিয়, বৈরাগ্যবাদী এবং সন্দেহবাদীদের বিবেচনা করা হয় একদম অসম্পূর্ণ সংযুক্তি হিসেবে, যাদের নিজস্ব শক্তিশালী পূর্বানুমানের সাথে কোন সম্পর্কই নেই। এপিকিউরিয় দর্শনকে ডেমোক্রিটিয় পদার্থবিদ্যা এবং নীতিবিদ্যার বিরুদ্ধ সমন্বয় হিসেবে নেয়া হয়। বৈরাগ্যবাদ হচ্ছে প্রকৃতির উপর হেরাক্লিটাসের দূর কল্পনাশ্রয়ী চিন্তা এবং নিন্দুক-নৈতিকতাবাদী বিশ্ব দৃষ্টির সমন্বয়, যার সাথে কিছু এরিস্টটলিয় যুক্তিও ছিল। আর সর্বোপরি সন্দেহবাদকে মনে করা হয় এসব অন্ধ মতবাদে বিশ্বাসীদের মুখোমুখি প্রামাণিক মন্দ। এই দর্শনগুলো একপাক্ষিক এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ ঔদার্যের কারণে অসচেতনভাবেই আলেকজান্দ্রিয় দর্শনের সাথে যুক্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আলেকজান্দ্রিয় দর্শন চূড়ান্তরূপে বিবেচিত হয়েছে মহিমান্বয়ন এবং বিশৃঙ্খলায়; এই বিভ্রান্তিটি মোটাদাগে সংকল্পের সার্বজনীনতা, যাকে চিনে ফেলা যায়।
জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া- এই চক্রটি সবার জন্যই প্রযোজ্য। এই চক্রটি একটা লৌহ বলয় তৈরী করে, যে বলয়ের মধ্যে মানবিক সবকিছুই আবদ্ধ থাকে এবং যা তাকে অতিক্রম করতেই হয়। তাই এরিস্টটলের মধ্য দিয়ে সবচেঞ্চ উঁচুতে পৌঁছনোর পর গ্রীক দর্শন ম্লান হয়ে গেলে তা খুব আশ্চর্যজনক হতো না। তবে বীরের মৃত্যু তুলনীয় শুধু সূর্যাস্তের সাথে; পেট ফোলানো ব্যাঙের সাথে নয়।
এই জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং ক্ষয়ের চক্রটি খুব সার্বজনীন, অস্পষ্ট একটি সংস্কার বা ধারণা; যার অধীনে নিশ্চিতরূপেই সবকিছুর গতিক করা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না কিছুই। জীবনে ক্ষয় নিজেই নিজের রূপ দেখায়। সে কারণে এর কাঠামো জীবন কাঠামোর মতোই নিজের বৈশিষ্ট্যগুলোকে আঁকড়ে ধরে। শেষ পর্যন্ত, ইতিহাসের দিকে এক ঝলক নজর ফেরানো যাক- এপিকিউরিয়বাদ, বৈরাগ্যবাদ এবং সন্দেহবাদ কি স্বতন্ত্র প্রপঞ্চ? যে মানসিকতায় গ্রীস রোমের পথে ভুল করে চলে এসেছিল, তারা কি সেই রোমান মানসিকতার অনুসরণ করছে না? তাদের সারসত্তা কি এতটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, নিবিড়তম এবং চিরন্তন নয় যে, আধুনিক পৃথিবী তাদেরকে পরিপূর্ণ মরমী নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়?
এই পদ্ধতিগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব মনে করানোর জন্যই আমি এর উপর জোর দিচ্ছি। যা হোক, সাধারণভাবে সংস্কৃতির উপর এদের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের কারোই কিছু জানা নেই। তবে আরো পুরনো গ্রীক দর্শনের সাথে এদের সম্পর্কের কথা আমাদের জানা আছে।
দুঞ্চটো ভিন্ন ধারার উদার পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে গ্রীক দর্শনের। এ দুঞ্চটো ভিন্ন ধারার একটি হচ্ছে এপিকিউরিয়, বৈরাগ্যবাদী ও সন্দেহবাদী দর্শন। অন্যটি পরিচালিত হয়েছে আলেকজান্দ্রিয় চিন্তার সমন্বিত রূপের অধীনে। প্রাগুক্ত সম্পর্ক কি গ্রীক দর্শনের এই সমাপ্তি দেখার জন্যও আমাদেরকে এতটুকু তাড়িত করেনা? এটা উল্লেখযোগ্য যে, বিশ্বজনীন পরিধির প্লেটোনিক এবং এরিস্টটলিয় দর্শনের পরে আবির্ভূত নতুন পদ্ধতিগুলো এই ঋদ্ধ ঞ্চান-কাঠামোর সামনে ম্লান হয়ে যায়নি। বরং আরও পেছনে তাকিয়েছে আর সহজতম ঘরানার আশ্রয় নিয়েছে (যেমন পদার্থবিদ্যাকে গণ্য করার জন্য প্রাকৃতিক দার্শনিকদের কাছে এবং যুক্তিবিদ্যার জন্য সক্রেটিসের ঘরানাায় আশ্রয় নিলেও কি একই কথা প্রযোজ্য নয়?)। অধিকন্তু, কোন্‌ কারণে এই পদ্ধতিগুলো এরিস্টটলের পিছু পিছু গিয়ে তাদের ভিত্তিকে যেন অতীতেই তৈরী পেয়েছে? কেন ডেমোক্রিটাস এবং হেরাক্লিটাস সিনিকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত? ঘটনাক্রমেই কি এপিকিউরিয়, বৈরাগ্যবাদী এবং সন্দেহবাদীদের মাধ্যমে আত্ম-চৈতন্যর প্রতিটি মুহূর্ত তার অস্তিত্বের নির্দিষ্টতা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়? দুর্ঘটনাক্রমেই কি এই পদ্ধতিগুলো তাদের সামগ্রিকতার মধ্যে আত্ম-চৈতন্যর পরিপূর্ণ কাঠামোকে সাজিয়ে তোলে?
চূড়ান্ত রূপে, পুরাণ অনুসারে, সাতজন ঞ্চানী লোক হতে যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে গ্রীক দর্শনের যাত্রা শুরু, বলতে গেলে যা এর প্রাণ, সক্রেটিসের মধ্যেই জ্ঞব্রহ্মাঞ্চ হিসেবে তা রূপ লাভ করেছিল। জ্ঞব্রহ্মাঞ্চ বলতে আমি বুঝিয়েছি ঞ্চানী লোকের, তার্কিকের বৈশিষ্ট্যকে। এটাও কি দুর্ঘটনা যে, ঐ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এটি নিখাদ বিঞ্চানের বাস্তবতার মতোই জোর দিয়ে বিবৃত হতে পারে?
আমার মনে হয়, যদিও প্রথমদিককার পদ্ধতিগুলো বিষয়বস্তুর দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতুহলোদ্দীপক; এরিস্টটল পরবর্তী সময়ের, প্রাথমিকভাবে এপিকিউরিয়, বৈরাগ্যবাদী এবং সন্দেহবাদী বলয়ের ঘরানা তার বিষয়ীগত আঙ্গিকের জন্য আরো বেশী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত আর কৌতুহলোদ্দীপক, যা গ্রীক দর্শনের চরিত্র। তবে এই বিষয়ীগত আঙ্গিক, দার্শনিক পদ্ধতির মরমী অবস্থানই এখন পর্যন্ত পরাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের খাতিরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এপিকিউরিয়, বৈরাগ্যবাদী এবং সন্দেহবাদী দর্শনের সামগ্রিকতা এবং পূর্বে ও পরের গ্রীক চিন্তার সাথে এদের সম্পর্ক নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা তোলা রইল।
এই সম্পর্ক বিকাশের শুধুমাত্র এক দিকের উদাহরণ হলেই আপাততঃ চলবে; আর তা হল পূর্ব দূর-কল্পনা সাথে তাদের সম্পর্ক।
এ রকম উদাহরণ হিসেবে আমি এপিকিউরিয় এবং ডেমোক্রিটিয় প্রাকৃতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্যকে নির্বাচিত করছি। আমি বিশ্বাস করিনা যে, পুরো ব্যাপারটাকে জোড় দিতে এটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক ক্ষেত্র। বস্তুতঃ একদিকে ডেমোক্রিটিয় এবং এপিকিউরিয় পদার্থবিদ্যা সনাক্ত করার পুরনো এবং সুরক্ষিত পক্ষপাত; যে কারণে এপিকিউরাসের বিশেষত্ব শুধুমাত্র স্বেচ্ছাচারী বিকৃত চিন্তায় দেখা যায়। অন্য দিকে যতটা সম্ভব খুঁটিনাটির জন্য আমি আনুবীক্ষণিক পরীক্ষার মতো পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছি। এর কারণ হচ্ছে যে, এই পক্ষপাত দর্শনের ইতিহাসের মতোই পুরাতন; আর পার্থক্যগুলো এত সূক্ষ্ম যে, তাদেরকে যেন শুধুমাত্র অনুবীক্ষনিক যন্ত্র দিয়েই খুঁজে বের করা যেতে পারে। ডেমোক্রিটিয় এবং এপিকিউরিয় পদার্থবিদ্যার মধ্যে আন্তঃনির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও যদি একটি প্রামানিক পার্থক্য যথাসম্ভব সূক্ষ্মভাবে দেখানো যায়, তাহলে এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ক্ষুদ্র জিনিসটা প্রমাণ করতে পারলে বড় ব্যাপারটা আরও সহজে দেখানো যায়; যেখানে উল্টোদিকে খুব সাধারণ বিবেচনা সন্দেহ রেখে যায় যে, খুঁটিনাটিতে প্রয়োগ করলে আগের পাওয়া ফলটা একই থাকবে কিনা।

পরবর্তী অংশ