Marxists Internet Archive
Bangla Section


অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

তৃতীয় পান্ডুলিপি: ব্যক্তি সম্পত্তি এবং শ্রম।
ব্যক্তি সম্পত্তির সঞ্চালনের উৎপত্তি হিসেবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র

(ত) ব্যক্তি সম্পত্তির বিষয়ীগত সারসত্তা- (খোদ নিজের জন্য ক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি,বিষয়ী হিসেবে ব্যক্তি হিসেবে)- হলো শ্রম। এটা তাই প্রমাণিত যে, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র শ্রমকে তার নীতি হিসেবে স্বীকার করে (যেমন করেছেন এডাম স্মিথ) আর তাই যা ব্যক্তি সম্পত্তিকে নিছক মানুষের বাইরের শর্ত হিসেবে দেখে না- সেই রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকেই বিবেচনা করতে হবে একদিকে ব্যক্তি সম্পত্তির বাস্তব শক্তি এবং বাস্তব সঞ্চালনের একটি উৎপন্ন হিসেবে, ব্যক্তি সম্পত্তির বাস্তব শক্তি এবং বাস্তব সঞ্চালনের একটি উৎপন্ন হিসেবে (ব্যক্তি সম্পত্তির এটা চৈতন্যে নিজের কাছে স্বাধীন হওয়া- একটি সঞ্চালন- আত্ম হিসেবে আধুনিক শিল্প)- আধুনিক শিল্পের একটি উৎপন্ন হিসেবে- আর অপরদিকে, এমন এক বল হিসেবে যা আধুনিক শিল্পের শক্তি এবং বিকাশকে ত্বরান্বিত ও মহিমান্বিত করেছে আর একে চৈতন্যের রাজ্যে একটা ক্ষমতা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
ব্যক্তি সম্পত্তির মাঝে ধন দৌলতের বিষয়ীগত সারসত্তা আবিষ্কার করা আলোকপ্রাপ্ত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকে, ব্যক্তি সম্পত্তিকে, কেবল মানুষের মোকাবিলা করা বিষয়গত সার উপাদান হিসেবে দেখনেওয়ালা অর্থ এবং বাণিজ্য ব্যবস্থার ভক্তিকারীদের তাই মনে হয় অন্ধ পূজারী, ক্যাথলিক। এডাম স্মিথকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের লুথার বলে এঙ্গেলস ভুল করেন নি।** ঠিক যেমন লুথার ধর্মবিশ্বাসকে বাহ্যিক জগতের সার উপাদান বলে মেনে নিয়ে তারই ফলস্বরূপ ক্যাথলিক প্যাগানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, ঠিক যেমন করে ধার্মিকতাকে মানুষের ভেতরকার সার উপাদান বানিয়ে তিনি বাহ্যিক ধার্মিকতাকে অতিক্রম করেন, ঠিক যেমন করে তিনি পুরোহিতকে আমজনতার হৃদয়ে গেঁথে দেবার কারণে আমজনতার বাইরের পুরোহিতকে অস্বীকার করেন; ঠিক একই হিসেব খাটে ধনদৌলতের ব্যাপারে। ধনসম্পদ মানুষের বাইরের এবং তার থেকে স্বাধীন কিছু একটা হিসেব আর ঐ কারণগুলোতেই এটা এমন একটা কিছু যা কেবল এক বাহ্যিক ফ্যাশনেই রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিবৃত করা যায়। সেই হিসেবেই তা বিনাশ প্রাপ্ত হয়। তার মানে ধন দৌলতের এই বাহ্যিক, মননহীন বিষয়গততা বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তার সাথে যায় ব্যক্তি সম্পত্তি, মানুষের নিজের মাঝে অঙ্গীভূত বলে এবং যায় মানুষ নিজেও, এর সারসত্তা হিসেবে স্বীকৃত বলে। কিন্তু এর ফলে মানুষ এসে পড়ে ব্যক্তি সম্পত্তির কক্ষপথে। ঠিক যেমন লুথারের বেলায় তাকে আনা হয় ধর্মের কক্ষপথে। মানুষকে স্বীকৃতি দেবার সদৃশের নিচে শ্রমের নীতিওয়ালা রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র বরং মানব অস্বীকৃতির যৌক্তিক উপসংহারে পৌঁছে যায়। যেহেতু মানুষ নিজে আর ব্যক্তি সম্পত্তির সারবস্তুর প্রতি চাপযুক্ত বাহ্যিক সম্পর্কে অবস্থান করছে না, বরং সে নিজেই হয়ে গেছে ব্যক্তি সম্পত্তির এই চাপযুক্ত সারসত্তা। পূর্বে যা ছিল কারোর কাছে বাহ্যিক, মানুষের বাস্তব বাহ্যিকীকরণ- তা হয়ে গেল নিছক বাহ্যিক করার ক্রিয়া, বিজাতীয় করার প্রক্রিয়া।
এই রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের শুরুটা হয় মানুষের প্রতীয়মান স্বীকৃতি দিয়ে (তার স্বাধীনতা, স্বতঃস্ফূর্ততা ইত্যাদি)। তারপর মানুষের নিজের সত্তায় ব্যক্তি সম্পত্তি চিহ্নিত করে এটা আর ব্যক্তি সম্পত্তির স্থানীয়, জাতীয় বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে শর্তায়িত হতে পারে না- যেহেতু তা নিজেরই বাইরে অস্তিত্বশীল কিছু একটা । আনুসঙ্গিকভাবে, এই রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র একটা কসমোপলিটন, সার্বজনীন শক্তি প্রদর্শন করে, যা প্রতিটি বিধি নিষেধ এবং বন্ধনকে উৎখাত করে, যেন সে একক রাজনীতি, একক সার্বজনীনতা, একক সীমা এবং একক বন্ধনের স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারপর হতেই এর তৎপরবর্তী বিকাশের স্তরক্রমে তাকে এই ভন্ডামী ছুঁড়ে ফেলতেই হয়, বেরিয়ে আসতে হয় তার পরিপূর্ণ মানব বিদ্বেষিতায়। এই তত্ত্বের ফলে যত প্রতীয়মান ঝামেলাতে তাকে জড়াতে হয়। সেগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েই সে এই কাজটা করে। তার জন্য তাকে ধন দৌলতের একক সারসত্তা হিসেবে শ্রম ধারণাটিকে আরো বেশি একপাক্ষিক তাই আরো তীক্ষ্ণ এবং সুস্থিতভাবে বিকশিত করতে হয়; এই তত্ত্বের নিহিতার্থকে বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে, অন্যান্য মৌলিক প্রস্তাবনার তুলনায় প্রতি-মানবিক বলে প্রমাণ করতে হয়। শেষে মরণ আঘাত নেমে আসে খাজনার ওপর, যে খাজনা ব্যক্তি সম্পত্তির শেষ, স্বতন্ত্র, স্বাভাবিক ধরণ, আর যে শ্রম সঞ্চালনের থেকে স্বাধীনভাবে বহাল থাকা ধনদৌলতের উৎস, যে সামন্ত সম্পত্তির এমন এক প্রকাশ যা ইতঃমধ্যেই বৈশিষ্ট্যে পুরোপুরি অর্থনৈতিক হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রকে রুখতে অক্ষম। (রিকার্ডো ঘরানা।) স্মিথ হতে সে* হয়ে রিকার্ডো, মিল ইত্যাদিতে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের মানব বিদ্বেষিতায় কেবল আপেক্ষিক বৃদ্ধিই ঘটেনি, শিল্পের নিহিতার্থ শেষে বলা লোকগুলোর চোখে ক্রমাগত বেশি বিকশিত আর দ্বন্দ্বশীল বলে প্রতীয়মান হতে লাগলো। এই পরবর্তী অর্থশাস্ত্রীরা তাদের পূর্বসূরীদের চাইতে তাদের মানুষ হতে বিচ্ছিন্নতায়, সদার্থেই নিরন্তর এবং সচেতনভাবে বেশি এগিয়ে ছিলেন। যা হোক, তারা তা করতে পারার কারণ কেবল এই যে তাদের বিঞ্চান আরো সংহত এবং সত্যনিষ্ঠভাবে বিকশিত। কারণ তারা ব্যক্তি সম্পত্তিতে এর সক্রিয় আঙ্গিকে বিষয়ী বানিয়েছিলেন, এমনি করে যুগপৎভাবে মানুষকে সারসত্তায় পাল্টে নিয়েছিলেন- আর একই কালে অপ্রামাণিকতা হিসেবে মানুষকে সারসত্তায় পাল্টে নিয়েছিলেন। বাস্তবতার দ্বন্দ্বটি পুরোপুরিভাবে তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করা পরস্পরবিরোধী সত্তার সাথে সম্পর্কিত। একে অস্বীকার করার ধারে কাছে না গিয়ে, ভাঙাচোরা শিল্প জগত নিজেদের ভাঙাচোরা নীতিই সুনিশ্চিত করে। সর্বোপরি, তাদের নীতি হল এই ভাঙাচোরার নীতি।
ড. কোয়েসনের ফিজিওক্রেটিক মতবাদ বাণিজ্য পদ্ধতি থেকে এডাম স্মিথে উত্তরণের প্রক্রিয়া গঠন করেছে। ফিজিওক্রেসি সরাসরি অর্থনৈতিক পরিভাষাতে সামন্ত সম্পত্তি পচনের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তাই এটা এর অর্থনৈতিক রূপান্তর এবং পুনরুদ্ধার সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে, তবে এটুকু ছাড়া যে, এর ভাষা এখন আর সামন্তীয় নয় বরং অর্থনৈতিক। সব ধন সম্পত্তি ভূমি এবং চাষবাসে (কৃষি) মিশে গেছে, ভূমি এখনো পুঁজি নয়। এটা এখনো এর অস্তিত্বের একটা বিশেষ ধরণ, যার কার্যকর মূল্যমান এর স্বাভাবিক উপাদান, যেখানে বাণিজ্য পদ্ধতি কেবলমাত্র মূল্যবান ধাতুর আঙ্গিকেই ধনসম্পদের অস্তিত্ব কবুল করে। এভাবে ধন সম্পদের বিষয়- এর বিষয়বস্তু প্রকৃতির সীমার ভেতরেই সরাসরি সার্বজনীনতার সর্বোচ্চ স্তর অর্জন করে। এমনকি প্রকৃতি হিসেবেও এটি প্রত্যক্ষ বিষয়গত ধন সম্পদ। আর ভূমি মানুষের জন্য অস্তিত্বশীল কেবল শ্রমের মাধ্যমে, কৃষির মাধ্যমে।
এমনি করে ধনসম্পদের বিষয়ীগত সারসত্তা ইতিমধ্যেই শ্রমে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে কৃষিই হচ্ছে একমাত্র উৎপাদনশীল শ্রম- যেহেতু শ্রমকে এখনো তার সাধারণত্ব এবং অমূর্ততায় কব্জা করা যায় নি। এর বিষয়বস্তুর মতোই এটি এখনো একটি বিশেষ স্বাভাবিক উপাদানে আটকা পড়ে আছে, আর তাই এটি কেবল প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত একটি বিশেষ অস্তিত্বের ধরণেই স্বীকৃত। এটি তাই এখনো কেবল মানুষের একটি নির্দিষ্ট এবং বিশেষ বিজাতীয়তা। ঠিক যেমন একই ভাবে এর উৎপন্নকে ভাবা হয় ধনসম্পদের প্রায় একটা বিশেষ আঙ্গিক [হিসেবে] যার জন্য শ্রমের নিজের চাইতে প্রকৃতির কাছেই ধর্ণা দিতে হয় বেশি। ভূমি এখানে এখনো মানুষ হতে স্বাধীন প্রকৃতির একটি প্রপঞ্চ হিসেবে স্বীকৃত- এখনো পুঁজি হিসেবে নয়, তার মানে শ্রমের নিজের একটি প্রেক্ষিত হিসেবে। শ্রম বরং ভূমির একটি প্রেক্ষিত হিসেবে প্রতীয়মান। কিন্তু পুরাতন বাহ্যিক, শুধুমাত্র বিষয় হিসেবে অস্তিত্বশীল ধনসম্পদের প্রতিক পূজা খুব সরল স্বাভাবিক উপাদানে পর্যবাসিত হয়েছে, আর কেবল আংশিক এবং বিশেষ আঙ্গিকে হলেও এর সারসত্তা এরই বিষয়ীগত অস্তিত্বের মাঝে স্বীকৃত হয়েছে। তখন ধনসম্পদের সাধারণ স্বভাব উন্মোচন করতে আবশ্যকীয় অগ্রবর্তী পদক্ষেপ দেয়া হলো; আর তা হলো নীতি হিসেবে শ্রমকে এর সামগ্রিক পরমতায় (মানে এর অমূর্ততায়) উত্থিত করা। ফিজিওক্রেসির বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানো হয় যে কৃষি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে (বলতে গেলে যা একমাত্র অর্থপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি) অন্য কোন শিল্প হতে ভিন্ন নয়; আর তাই ধনসম্পদের সারসত্তা কোন বিশেষ উপাদানের সীমায় বাঁধা শ্রমের বিশেষ প্রকাশ, মানে শ্রমের কোন বিশেষ আঙ্গিক নয়, বরং তা হলো সাধারণ শ্রম।
শ্রমকে ধনসম্পদের সারসত্তা বলে ঘোষণা করে ফিজিওক্রেসি বিশেষ, বাহ্যিক, নিছক বিষয়গত ধনসম্পদ অস্বীকার করে। কিন্তু ফিজিওক্রেসির কাছে শ্রম প্রথমে কেবল ভূমিগত সম্পত্তির বিষয়ীগত সারসত্তা। (এর যাত্রা শুরু হয় সেই ধরণের সম্পত্তি হতে যা ঐতিহাসিকভাবে দাপুটে এবং স্বীকৃত ধরণ বলে প্রতীয়মান হয়।) এটি শুধু ভূমিগত সম্পত্তিকে বিজাতীয় হওয়া মানুষে পরিণত করে। শিল্পকে (কৃষি) এর সারসত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সে নিজের সামন্ত চরিত্র রদ করে দেয়। কিন্তু কৃষিকেই একমাত্র শিল্প ঘোষণা দিয়েই সে শিল্পের জগতকে অস্বীকৃতি জানিয়ে সামন্ত পদ্ধতিকেই স্বীকৃতি দেয়।
একটা কথা এখন পরিষ্কার। যদি এখন শিল্পের বিষয়ীগত সারসত্তা কব্জা করা গেল (ভূমিগত সম্পত্তির বিপরীতে শিল্পের মানে- যে শিল্প নিজেকে শিল্প হিসেবে গঠিত করেছে তার), তবে এই সারসত্তা এর নিজের মাঝেই এর উল্টোটাও ধারণ করে। কারণ ঠিক যে হিসেবে শিল্প রদ করা ভূমিগত সম্পত্তি অঙ্গীভূত করে, একই কালে শিল্পের বিষয়ীগত সারসত্তা ভূমিগত সম্পত্তির বিষয়ীগত সারসত্তাও অঙ্গীভূত করে।
ঠিক যেমন ভূমিগত সম্পত্তি ব্যক্তি সম্পত্তির প্রথম আঙ্গিক, শিল্প প্রথমে এর মোকাবিলা করে ঐতিহাসিকভাবে নিছক একটা বিশেষ ধরণের সম্পত্তি হিসেবে- অথবা ভূমিগত সম্পত্তির নিছক মুক্তিপ্রাপ্ত দাস হিসেবে- ঠিক তেমনি করেই ব্যক্তি সম্পত্তির বিষয়ীগত সারসত্তা মানে শ্রমের বৈঞ্চানিক বিশ্লেষণের এই পদ্ধতিটিই নিজেকে পুনরাবির্ভূত করে। শ্রম প্রথমে প্রতীয়মান হয় কেবল কৃষি শ্রম হিসেবে; কিন্তু তারপর নিজেকে সাধারণ শ্রম হিসেবে বিবৃত করে।
সকল সম্পদই হয়ে উঠেছে শিল্প সম্পদ, শ্রমের সম্পদ। আর শিল্প হলো সম্পাদিত শ্রম, ঠিক যেমন কারখানা পদ্ধতি হচ্ছে শিল্পের নিখুঁত করা সারসত্তা; মানে শ্রমের সারসত্তা, ঠিক যেমন শিল্প পুঁজি হচ্ছে ব্যক্তি সম্পত্তির সম্পাদিত বিষয়গত আঙ্গিক।
এখন আমরা দেখতে পারি কেমন করে কেবল এই বিন্দুতে এসেই ব্যক্তি সম্পত্তি মানুষের উপর তার আধিপত্য সম্পন্ন করে এর সবচাইতে সাধারণ আঙ্গিক একটা বিশ্ব ঐতিহাসিক ক্ষমতা হয়ে উঠতে পারে।
[ব্যক্তি সম্পত্তি এবং কমিউনিজম]
শ্রম এবং পুঁজির এন্টিথিসিস হিসেবে অনুধাবন করতে না পারলে সম্পত্তিহীনতা এবং সম্পত্তির মাঝে এন্টিথিসিসটি একটি অবিচ্ছেদ্য এন্টিথিসিস হিসেবে থেকে যায়। একে তাদের সক্রিয় সংযোগে, অন্তর্গত সম্পর্কে বোঝা যায় না। আর তা না বুঝলে এটিকে দ্বন্দ্ব হিসেবেও অনুধাবন করা যায় না। এটা প্রকাশিত হতে পারে এই প্রথম আঙ্গিকেও, এমনকি ব্যক্তি সম্পত্তির অগ্রসর বিকাশ ছাড়াই- যেমন প্রাচীন রোম, তুরস্ক ইত্যাদিতে। এটি এখনো খোদ ব্যক্তি সম্পত্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হিসেবে প্রতীয়মান হয়না। কিন্তু শ্রম (সম্পত্তির বর্জন হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি বিষয়ীগত সারসত্তা) এবং পুুঁজি (শ্রমের বর্জন হিসেবে বিষয়গত শ্রম) ব্যক্তি সম্পত্তি গঠন করে এর দ্বন্দ্বের বিকশিত দশা হিসেবে- আর তাই তা হয় সমাধানের দিকে ধাবমান এক গতিশীল সম্পর্ক।
আত্ম-বিচ্ছিন্নতা হতে অতিক্রমণ আত্ম-বিচ্ছিন্নতার মত একই স্তরক্রম অনুসরণ করে। ব্যক্তি সম্পত্তি প্রথমে কেবল এর বিষয়গত প্রেক্ষিতে বিবেচিত হয়; তথাপি শ্রমকে এর সারসত্তা ধরে নয়। তাহলে এর অস্তিত্বের আঙ্গিক হল পুঁজি, যাকে এমন হিসেবেই রদ্‌ করতে হবে (প্রুঁধো)। অথবা বিশেষ আঙ্গিকের শ্রম, আনুভূমিক করে দেয়া, খন্ড বিখন্ড শ্রম, যা এর ফলেই অমূর্ত। এরকম শ্রমকেই ব্যক্তি সম্পত্তির বিনাশতা এবং মানুষ হতে বিচ্ছিন্নতায় এর অস্তিত্বের উৎস হিসেবে ধারণা করা হয়। যেমন ফিজিওক্রেটদের মতই ফুরিয়েও কৃষি শ্রমকে উদাহরণ দেবার মত এক ধরণ বলে মনে করতেন; যখন সাঁ সিমো এর বিপরীতে ঘোষণা করেন যে এরকম শিল্প শ্রমই হচ্ছে সারসত্তা, এবং তদানুসারে শিল্পপতিদের বহির্ভূত নিয়মের প্রতি উচ্চাকাঙ্খা এবং শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি। চূড়ান্ত ভাবে, কমিউনিজম হল রদ্‌ করা ব্যক্তি সম্পত্তির ইতিবাচক প্রকাশ- প্রথমে সার্বিক ব্যক্তি সম্পত্তি হিসেবে। এই সম্পর্কতে সামগ্রিকভাবে কমিউনিজম হল :
(১) এর প্রথম আঙ্গিকে এর একটা সাধারণীকরণ এবং ভোগকরণ মাত্র (এই সম্পর্কের)। এই রূপে এটি আবির্ভূত হয় দ্বিবিধ আঙ্গিকে : এক দিকে, বস্তুগত সম্পত্তির রাজত্ব এত ফুলে ফেঁপে ওঠে যে, ব্যক্তি সম্পত্তি বা যা কিছুতেই দখলদারী করা যায় না ঐরকম সব কিছুকে সে ধ্বংস করে দিতে চায়। স্বেচ্ছাচারী পন্থায় প্রতিভা ইত্যাদিকে সে অবঞ্চা করতে চায়। তার জন্য জীবন ও অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সোজাসুজি শারীরিক ভোগ দখল । শ্রমিকের ক্যাটেগরি বিনাশ করা হয়না, বরং সকল মানুষে প্রসারিত হয়। ব্যক্তি সম্পত্তির সম্পর্ক জিনিসের জগতের প্রতি জনসম্প্রদায়ের সম্পর্ক হিসেবে নাছোড়বান্দার মত লেগে থাকে। ব্যক্তি সম্পত্তির প্রতি সার্বিক ব্যক্তি সম্পত্তির এই বৈরী সঞ্চালন শেষে গিয়ে তার প্রকাশ খুঁজে পায় নারী সম্প্রদায়ের বিবাহের প্রতি বিরোধিতার জান্তব আঙ্গিকে (নিঃসন্দেহে এটা অনন্য সাধারণ ব্যক্তি সম্পত্তির একটা আঙ্গিক)। এতে একজন নারী হয়ে যায় জনসম্প্রদায়গত এবং সাধারণ সম্পত্তির একটা টুকরো। বলা যেতে পারে যে, নারী সম্প্রদায়ের ভাবটি এই গূঢ় কথা ফাঁস করে দেয় যে, এই কমিউনিজম এখনো একদম আকাট আর চিন্তাশূন্য।(১২) ঠিক যেভাবে নারী বিবাহ থেকে সাধারণ পতিতাবৃত্তিতে যায়* তেমনি ধন সম্পদের সমগ্র জগত (মানে মানুষের বিষয় সার উপাদান) ব্যক্তি সম্পত্তির মালিকের সাথে একচেটিয়া বিবাহের সম্পর্ক হতে জনসম্প্রদায়ের সাথে সার্বজনীন পতিতাবৃত্তির দশায় উপনীত হয়। প্রতিটি বলয়েই মানুষের ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করে বলে এই ধরণের কমিউনিজম ব্যক্তি সম্পত্তির যৌক্তিক প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়, যার নেতিকরণ হল এই কমিউনিজম। নিজেকে একটা ক্ষমতা হিসেবে গড়ে তোলা সাধারণ ঈর্ষার এই ছদ্মবেশে লোভ নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত, পরিতৃপ্ত করে; তবে কেবল অন্য পথে। এ রকম করে ব্যক্তি সম্পত্তির প্রতিখন্ডের চিন্তা, ঈর্ষা এবং জিনিসগুলোকে একটা সাধারণ স্তরে পর্যবাসিত করার বাসনার আঙ্গিকে তা অন্ততঃ অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী ব্যক্তি সম্পত্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এতে এই ঈর্ষা এবং বাসনা এমনকি প্রতিযোগিতার সারসত্তা গঠন করে। আকাট কমিউনিজম নিছক এই ঈর্ষা এবং এই সমান করে দেয়ার শীর্ষবিন্দু, যার যাত্রা শুরু পূর্বধারণাকৃত ন্যূনতম হতে। এর একটা নির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ মাপকাঠি আছে। ব্যক্তি সম্পত্তির এই রদ্‌করণ আসলে বাস্তবে কতটা যথার্থকরণ তার আদতে প্রমাণ পাওয়া যায় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার সমগ্র জগতের অমূর্ত নেতিকরণের ঘটনাটি দিয়ে। দরিদ্র এবং স্থূল মানুষদের চাওয়া খুবই কম। তারা শুধু ব্যক্তি সম্পত্তির অতিক্রমেই ব্যর্থ হয় নি, বরং এখনো তার নাগালই পায়নি।
জনসম্প্রদায়টি কেবল শ্রমেরই জনসম্প্রদায় আর শ্রমের সাম্যটি প্রদান করা হয় জনসম্প্রদায়গত পুঁজি হতে সার্বিক পুঁজিপতি হিসেবে সম্প্রদায় দ্বারা। সম্পর্কের উভয়পক্ষই একটা কল্পিত সার্বিকতায় উত্তীর্ণ হয়। শ্রম উত্থিত সেই ক্যাটাগরি হিসেবে যাতে প্রতিটি ব্যক্তি স্থান পায় আর পুঁজি উত্থিত জনসম্প্রদায়ের স্বীকৃত সার্বিকতা এবং ক্ষমতা হিসেবে।
নারীর ক্ষেত্রে তাদের যে প্রস্তাবনা- তাতে নারীরা জনসম্প্রদায়গত লালসার হাতের পুতুলমাত্র। তা প্রকাশিত হয় এক অসীম অবমাননায় যেখানে পুরুষ তার নিজের জন্য অস্তিত্বশীল। এই প্রস্তাবনায় একটা খোলামেলা, প্রতারণাশীল, সোজাসাপ্টা এবং অনাবৃত প্রকাশ আছে। এবং সেই প্রকাশ নারী এবং পুরুষের সম্পর্কের- যাতে স্বাভাবিক এবং সরাসরি প্রজাতি সম্পর্ক ধারণা করে নেয়া হয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সরাসরি, স্বাভাবিক এবং প্রামাণিক সম্পর্কই নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক। এই স্বাভাবিক প্রজাতি সম্পর্কে পুরুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কই প্রত্যক্ষভাবে মানুষের সাথে তার সম্পর্ক, ঠিক যেমন মানুষের সাথে তার সম্পর্ক প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক- তার নিজস্ব স্বাভাবিক গন্তব্য। তাই এই সম্পর্কে সংবেদনগতভাবে পর্যবেক্ষণযোগ্য সংকুচিত সত্যতায় সেই বিস্তৃতি সীমা প্রকাশিত হয় যাতে মানব সারসত্তা পুরুষের কাছে প্রকৃতি হয়ে গেছে অথবা যাতে প্রকৃতি তার কাছে হয়ে গেছে পুরুষের মানব সারসত্তা। এই সম্পর্ক থেকেই তাই কেউ চাইলে মানুষের বিকাশের সামগ্রিক স্তর বিচার করতে পারে। এই সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য হতে আরো বোঝা যায় যে প্রজাতি সত্তা হিসেবে, পুরুষ হিসেবে, মানুষ কতটা নিজে যা- তা হয়ে উঠলো আর কতটাই বা নিজেকে অনুুধাবন করলো। পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্ক হল মানব সত্তার সাথে মানব সত্তার সবচাইতে স্বাভাবিক সম্পর্ক। তাই এটি সেই বিস্তৃতি উন্মোচন করে যাতে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ হয়ে গেছে মানবিক, অথবা সেই বিস্তৃতি যাতে তার মাঝে মানবিক সারসত্তা হয়ে গেছে স্বাভাবিক সারসত্তা। এই বিস্তৃতিতে তার মানব স্বভাব তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এই সম্পর্ক আরো একটি বিস্তৃতি প্রকাশ করে। তা হলো পুরুষের প্রয়োজনটি কতদূর মানবিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে; আর তাই এটি প্রকাশ করে অন্য ব্যক্তি তার জন্য ব্যক্তি হিসেবে কতটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে- যে বিস্তৃতিতে সে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বে একই কালে একজন সামাজিক সত্তা।
ব্যক্তি সম্পত্তির প্রথম ইতিবাচক রদ্‌ হিসেবে আকাট কমিউনিজম এমনি করেই নিছক এমন একটি আঙ্গিক যাতে ইতিবাচক জনসম্প্রদায় পদ্ধতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সম্পত্তির বিভৎসতা ওপরে ভেসে ওঠে।
(২) কমিউনিজম (ক) এখনো স্বভাবে রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক; (খ) রাষ্ট্রের বিলুপ্তির সাথে, যদিও এখনো অসম্পুর্ণ এবং এখনো ব্যক্তি সম্পত্তি দ্বারা প্রভাবিত তার মানে মানুষের বিচ্ছিন্নতা দ্বারা। এবং উভয় আঙ্গিকেই কমিউনিজম ইতিমধ্যেই সত্তার পুনরেকত্রীকরণ অথবা মানুষের নিজের কাছে নিজের ফিরে আসা সম্বন্ধে তা মানব আত্ম-বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কেও সমান রকম সজাগ। ব্যক্তি সম্পত্তির ইতিবাচক সারসত্তা এবং প্রয়োজনের মানবীয় প্রকৃতি বুঝতে না পারার ফলে এটি ব্যক্তি সম্পত্তির কাছেই বন্দি হয়ে আছে, আক্রান্তও হচ্ছে। আসলে এটি ব্যক্তি সম্পত্তির ধারণা কব্জা করতে পারলেও সারসত্তার নাগাল পায়নি।
(৩) মানব আত্ম-বিচ্ছিন্নতা হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি, ব্যক্তি সম্পত্তির ইতিবাচক অতিক্রমণ হিসেবে কমিউনিজম, আর তাই মানুষ দ্বারা এবং মানুষের জন্য মানব সারসত্তার বাস্তব যথার্থকরণ । তাই সামাজিক (তার মানে মানবিক) সত্তা হিসেবে মানুষের নিজের কাছে নিজের সম্পূর্ণ প্রত্যাবর্তন হিসেবে কমিউনিজম হল পূর্বতন বিকাশের সমস্ত সম্পদকে আলিঙ্গন করে সচেতনভাবে সম্পাদিত প্রত্যাবর্তন। পরিপূর্ণ বিকশিত প্রকৃতিবাদ হিসেবে এই কমিউনিজম মানবতাবাদের সমান আর পরিপূর্ণ বিকশিত মানবতাবাদ সমান প্রকৃতিবাদ। এ হলো মানুষ এবং প্রকৃতি আর মানুষ এবং মানুষের মাঝের দ্বন্দ্বের নিখাদ সমাধান। অস্তিত্ব এবং সারসত্তার মাঝের, বিষয়করণ এবং আত্ম নির্ধারণের, মুক্তি এবং প্রয়োজনীয়তার, স্বতন্ত্র এবং প্রজাতির মাঝের বৈরীতার সত্যিকারের সমাধান। কমিউনিজম হলো ইতিহাসের ধাঁধাঞ্চর সমাধান আর তা নিজেও জানে যে সে এই সমাধান।
ইতিহাসের সামগ্রিক সঞ্চালনটি (এর বাস্তব আদি উদ্ভব ক্রিয়ার মতো- এর অভিঞ্চতাগত অস্তিত্বের জন্মক্রিয়ার মতোই) তাই এর চিন্তাশীল চৈতন্যের কাছে তার হয়ে ওঠার অনুধাবনকৃত এবং ঞ্চাত প্রক্রিয়া। যেখানে অপরিপক্ক কমিউনিজম এখনো নিজের জন্য ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে ফেরে। সে প্রমাণ খোঁজা হয় যা ইতিমধ্যে বহাল তার সীমানার ভেতরে- ব্যক্তি সম্পত্তির বিপরীতে দাঁড়ানো বিচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক প্রপঞ্চের মাঝে; ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া থেকে কোন স্বতন্ত্র স্তরকে ছিড়ে এনে এর ঐতিহাসিক ঠিকুজি হিসেবে সেই স্বতন্ত্র স্তরের ওপর মনযোগ নিবিষ্ট করে (এই শখের ঘোড়ার ওপর প্রাণপনে চেপে বসেছিলেন ক্যাবে, ভিলে গার্দেল প্রমুখরা)। এসব করে সে নিজেই এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, এই প্রক্রিয়ার বিশাল অংশটাই এর দাবির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ আর যদি কখনো এই ধরণের কমিউনিজম অস্তিত্বশীল থাকেও তাহলে অতীতে এর অস্তিত্বশীলতা বাস্তবতায় এর শ্লাঘাকে খারিজ করে।
এটা সহজেই দেখা যায় যে, সমগ্র বৈপ্লবিক সঞ্চালনটি এর অভিঞ্চতাগত এবং তাত্ত্বিক ভিত্তি দুই- ই খুঁজে পায় প্রামাণিকভাবে ব্যক্তি সম্পত্তির সঞ্চালনে- আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে অর্থনীতিতে।
এই বস্তুগত প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধিযোগ্য ব্যক্তি সম্পত্তি হলো বিচ্ছিন্ন মানব জীবনের বস্তুগত উপলব্ধিযোগ্য প্রকাশ। এর সঞ্চালন- উৎপাদন এবং ভোগ হলো এখন পর্যন্ত সমস্ত উৎপাদনের সঞ্চালনের উপলব্ধিযোগ্য উৎঘাটন, তার মানে মানুষের উপলব্ধিকরণ বা এর বাস্তবতা। ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র, আইন, নৈতিকতা, বিঞ্চান, শিল্প প্রভৃতি কেবল উৎপাদনের নির্দিষ্ট ধরণ এবং এগুলো উৎপাদনের সাধারণ নিয়মাধীন। মানব জীবন যথার্থকরণ হিসেবে ব্যক্তিসম্পত্তির অতিক্রমণ তাই সমস্ত বিচ্ছিন্নতার ইতিবাচক অতিক্রমণ। তার মানে ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র ইত্যাদি হতে মানুষের নিজের মানবিক মানে সামাজিক অস্তিত্বে ফিরে আসা। এই রকমের ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতা কেবল চৈতন্যের জগতে মানুষের অন্তর্গত জীবনেই ঘটে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা হলো বাস্তব জীবনের। সুতরাং এই অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এটি উভয় প্রেক্ষিতে অতিক্রম তথা আলিঙ্গন করে। এটা প্রমাণিত যে, বিভিন্ন জনগণের মাঝে সঞ্চালনটির প্রথমদিককার দশা নির্ভর করে জনগণের সত্যিকারের স্বীকৃত জীবন নিজেকে চৈতন্যে নাকি বাহ্যিক জগতে বেশি প্রকাশিত করে- মানে এটা কি বেশি ভাবগত নাকি বেশি বাস্তব তার ওপর। কমিউনিজম যাত্রা থেকেই (ওয়েন) শুরু করে নাস্তিকতা সহ কিন্তু প্রথম দিকে নাস্তিকতা কমিউনিজম হওয়া থেকে অনেক দুরে। আসলেও নাস্তিকতা অনেকাংশেই এখনো একটা অমূর্তকরণ।
তাই নাস্তিকতার মানব হিতৈষীতা প্রথমে কেবল দার্শনিক অমূর্ত মানবহিতৈষীতা আর কমিউনিজমের মানবহিতৈষীতা তাৎক্ষণিক বাস্তব এবং সরাসরি কাজে নেমে পড়া।
আমরা দেখেছি ইতিবাচকভাবে রদ্‌কৃত ব্যক্তিগত সম্পত্তির মেনে নেয়াতে কেমন করে মানুষ মানুষকে, নিজেকে এবং অন্য মানুষকে উৎপাদন করে; কেমন করে তার স্বতন্ত্রতার সরাসরি প্রকাশ হওয়া হওয়া বিষয় যুগপৎভাবে অন্য মানুষের পণ্য তার নিজের অস্তিত্ব, অন্য মানুষের অস্তিত্ব এবং তার নিজের জন্য অস্তিত্ব হয়ে প্রকাশিত হয়। একইভাবে শ্রমের বিষয়বস্তু এবং বিষয়ী হিসেবে মানুষ দুটো সঞ্চালনের যাত্রাবিন্দু এবং তার ফলও (আর মোদ্দা কথায় এই সত্যতায় যে তারা অবশ্যই যাত্রাবিন্দু গঠন করবে যা কিনা ব্যক্তি সম্পত্তির ঐতিহাসিক আবশ্যকীয়তায় নিহিত)। এভাবে সমগ্র সঞ্চালনটির সামাজিক চরিত্রই সাধারণ চরিত্র : যেমন করে সমাজ নিজে মানুষকে মানুষ হিসেবে উৎপাদন করে, তেমনি সমাজও মানুষ দ্বারা উৎপাদিত হয়। ক্রিয়া এবং উপভোগ উভয়েই তাদের আধেয় এবং অস্তিত্বের ধরণে সামাজিক : সামাজিক ক্রিয়া এবং সামাজিক উপভোগ। প্রকৃতির মানবপ্রেক্ষিত কেবল সামাজিক মানুষের জন্যই অস্তিত্ববান; কারণ কেবল তখনই প্রকৃতি তার জন্য মানুষের সঙ্গে বন্ধন হিসেবে- তার অস্তিত্ব অন্যের জন্য এবং অন্যদের অস্তিত্ব তার জন্য বহাল থাকে আর মানব বাস্তবতার জীবন উপাদান হিসেবে কেবল তখনই তার নিজের মানব অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে প্রকৃতি অস্তিত্বশীল থাকে। কেবল এখানেই যা তার কাছে স্বাভাবিক অস্তিত্ব তা হয় মানব অস্তিত্ব, আর প্রকৃতি তার কাছে মানুষ হয়ে যায়। এভাবে সমাজ হলো প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পূর্ণ ঐক্য- প্রকৃতির সত্যকারের পুনরুত্থান- মানুষের সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রকৃতিবাদ এবং প্রকৃতির সুসামঞ্জস্যপূর্ণ মানবতাবাদ।
সামাজিক ক্রিয়াশীলতা এবং সামাজিক উপভোগ টিকে থাকে আর কোন উপায়ে নয়, কেবল কতিপয় সরাসরি সম্প্রদায়গত ক্রিয়াশীলতা এবং সরাসরি সম্প্রদায়গত উপভোগের রূপ ধরে। যদিও সম্প্রদায়গত ক্রিয়াশীলতা এবং সম্প্রদায়গত উপভোগ (তার মানে ক্রিয়াশীলতা ও উপভোগ যা প্রকাশিত এবং সরাসরি উন্মোচিত হয় অপর মানুষের সাথে বাস্তব সহযোগিতায়) ঘটবে যেখানে সামাজিকতার একটা সরাসরি প্রকাশ পল্লবিত হয় ক্রিয়াশীলতার উপাদানের সত্যিকারের বৈশিষ্ট্য হতে এবং যখন তা উপভোগের প্রকৃতির সঙ্গে সুস্থিত থাকে।
কিন্তু আবার যখন আমি বিঞ্চান সম্মত, অন্যান্যভাবে ক্রিয়াশীল- (অর্থাৎ এমন একটা ক্রিয়াশীলতায় যেখানে আমি কদাচিৎ অপরের সঙ্গে সরাসরি যোগ স্থাপন করি) তখনও আমার ক্রিয়াশীলতা সামাজিক; কারণ আমি এটা করি একজন মানুষ হিসেবে। শুধুমাত্র আমার ক্রিয়ার বিষয়বস্তুই যে আমার কাছে সামাজিক উৎপন্ন হিসেবে প্রদত্ত হয় তাই নয় (এমনকি চিন্তাকারী ব্যক্তি যাতে সক্রিয় সেই ভাষাও সমাজ উৎপন্ন) : আমার নিজের অস্তিত্বও সামাজিক ক্রিয়া। আর তাই এই অস্তিত্ব আমি নিজেই তৈরী করেছি, করেছি সমাজের জন্য, সামাজিক সত্তা হিসেবে আমার নিজের চৈতন্য দিয়ে।
আমার সাধারণ চৈতন্য কেবল তারই তাত্ত্বিক আকার যার জীবন্ত আকার হল বাস্তব জনসম্প্রদায়; সামাজিক তন্তু। যদিও বর্তমান দিনে সাধারণ চৈতন্য বাস্তব জীবন থেকে তৈরী করা এক অমূর্তায়ন আর এই রূপ ধরে তা বৈরভাবে এর মোকাবিলা করে। ক্রিয়া হিসেবে আমার সাধারণ চৈতন্যের ক্রিয়া তাই একই সাথে সমাজ সত্তা হিসেবে আমার তাত্ত্বিক অস্তিত্ব।
সর্বোপরি, স্বতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অমূর্তকরণ হিসেবে আবার সমাজের স্বতঃসিদ্ধয়িতকরণ থেকে এড়িয়ে যেতে হবে। স্বতন্ত্র হল সামাজিক সত্তা । তাদের জীবন প্রকাশ (এমনকি তা অন্যান্যদের সম্মিলনে কৃত জনসম্প্রদায়গত প্রকাশের সরাসরি আঙ্গিকে প্রতিভাত নাও হতে পারে, তাহলেও) তাই সামাজিক জীবনের এক প্রকাশ এবং অনুমোদন। মানুষের স্বতন্ত্র আর প্রজাতি জীবন পৃথক নয়, যদিও অনিবার্যভাবেই স্বতন্ত্রের অস্তিত্বের ধরণ প্রজাতির জীবনের অধিক বিশেষ বা অধিক সাধারণ ধরণ, অথবা প্রজাতির জীবন আরো অধিক বিশেষ বা অধিক সাধারণ স্বতন্ত্র জীবন।
তার প্রজাতির চৈতন্যে মানুষ তার বাস্তব সামাজিক জীবন অনুমোদন করে, তার বাস্তব অস্তিত্বকে চিন্তায় পুনরাবৃত্তি করে, ঠিক যেমন উল্টোভাবে প্রজাতির সত্তাটি নিজেকে প্রজাতি চৈতন্যে অনুমোদন করে আর এর নিজের জন্য এর সাধারণতায় চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে অস্তিত্বশীল থাকে।
মানুষ তাই যতটা নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র (আর সংক্ষেপে তার বৈশিষ্ট্যই তাকে একজন স্বতন্ত্র, এক বাস্তব স্বতন্ত্র সামাজিক সত্তা বানায়) ঠিক ততটাই খোদ্‌ নিজের জন্য কল্পিত এবং অভিঞ্চাত সমাজের সমগ্রতা - আদর্শ সমগ্রতা - বিষয়ীগত অস্তিত্ব। ঠিক যেভাবে যে সমাজ অস্তিত্বের সজাগতা ও বাস্তব উপভোগ এবং জীবনের মানব প্রকাশ উভয় ভাবেই বাস্তব জগতেও অস্তিত্বমান।
এভাবে চিন্তা এবং সত্তা নিশ্চয়ই ভিন্ন, কিন্তু একই কালে তারা একে অপরের সাথে ঐক্যবদ্ধ।
মৃত্যু যেন নির্দিষ্ট স্বতন্ত্রের ওপর প্রজাতির এক কর্কশ বিজয়, তা যেন তাদের ঐক্যের সঙ্গেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তবে নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র কেবল একটা নির্দিষ্ট প্রজাতি সত্তা, এভাবে সে মরণশীলও বটে।
(৪) ব্যক্তি সম্পত্তি যেমন কেবল এই সত্যতার উপলব্ধিযোগ্য প্রকাশ যে মানুষ নিজের কাছেই বিষয়মুখ হয়ে পড়েছে আর একই কালে নিজের কাছেই একটা আশ্চর্য এবং অমানবিক বিষয় হয়ে পড়েছে; ঠিক যেমন এটা এই সত্যতা প্রকাশ করে যে, তার জীবনের প্রকাশ মানেই তার জীবনের বিজাতীয়তা, তার উপলব্ধি করা মানেই হচ্ছে বাস্তবতাকে হারিয়ে ফেলা, এক বিজাতীয় বাস্তবতায় পতিত হওয়া- ঠিক তেমন ব্যক্তি সম্পত্তির ইতিবাচক অতিক্রমণ (মানে মানব সারসত্তা এবং মানবজীবনের, বিষয়গত মানুষের, মানব অর্জনের মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা উপলব্ধিযোগ্য যথার্থকরণ) কেবল প্রত্যক্ষ একপেশে উপভোগের দৃষ্টিতে, নিছক ভোগ দখল মালিকানার দৃষ্টিতে ধারণা করা উচিত নয়। মানুষ তার সমগ্র সারসত্তাকে সামগ্রিকভাবেই যথার্থ করে- তার মানে বলতে গেলে এক সমগ্র মানুষ হিসেবে জগতের সঙ্গে তার প্রতিটি মানবিক সম্পর্ক- দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, অনুভব, চিন্তা, পর্যবেক্ষণ, অভিঞ্চতা, চাওয়া, কাজ করা, ভালোবাসা- সংক্ষেপে তার স্বতন্ত্র সত্তার সকল অঙ্গসমূহ আঙ্গিকে সরাসরি সামাজিক অঙ্গগুলোর মতই তাদের বিষয়গত বিকাশ অভিমুখ করণ অথবা তাদের বিষয়ের প্রতি বিকাশ অভিমুখ করণ এ বিষয়ের যথার্থকরণ; মানব বাস্তবতার যথার্থকরণ। বিষয়ের প্রতি তাদের বিকাশ অভিমুখ করণ, মানব বাস্তবতার প্রকাশ।* এটা মানব ক্রিয়া এবং মানব যাতনা, কারণ মানবিক বিবেচনায় যাতনা মানুষের একধরণের আত্ম-উপভোগ।
ব্যক্তিসম্পত্তি আমাদের এতটাই বেকুব এবং একপেশে করেছে যে, আমরা যখন একটা বিষয় প্রাপ্ত হই তখন তা কেবলই আমাদের- অথবা তা আমাদের জন্য পুঁজি হিসেবে অস্তিত্বশীল। অথবা তখন এটা সরাসরি ভোগদখলকৃত, খেয়ে নেয়া, পান করে নেয়া, পরিধানকৃত, বাসকৃত- সংক্ষেপে তা আমাদের দ্বারা ব্যবহৃত। যদিও ব্যক্তি সম্পত্তি নিজেই আবার এই সব দখলের সরাসরি উপলব্ধিকে ধারণা করে কেবল জীবন ধারণের উপায় হিসেবে। যে জীবনের তারা উপায় হিসেবে সেবা করে তা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির জীবন- শ্রম এবং পুঁজিতে রূপান্তর। সকল শারীরিক এবং মানবিক ইন্দ্রিয় সমূহের স্থানে তাই চলে এসেছে এই সকল ইন্দ্রিয়ের পুরোদস্তুর বিচ্ছিন্নতা, অধিকারবোধের সংবেদন। মানবসত্তা যাতে তার অন্তর্গত সম্পদ বাইরের জগতে তুলে আনতে পারে তার জন্য তাকে চরম দারিদ্রে পর্যবাসিত করা হয়। (অধিকারবোধ ক্যাটাগরির জন্য দেখুন হেস এর উভশয়ধ।ংতশ।ভফ আষফনশ)
তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অতিক্রমণ হলো সমস্ত মানবিক সংবেদন এবং গুণাবলীর পরিপূর্ণ মুক্তি। তবে এটা যে এমন এক মুক্তি সংক্ষেপে তার কারণ হলো- এসব সংবেদন এবং গুণাবলী বিষয়ীগত এবং বিষয়গত ভাবে মানবিক হয়ে গেছে। চোখ হয়ে গেছে মানবিক চোখ, ঠিক যেমন এর বিষয় হয়ে গেছে সামাজিক, মানবিক বিষয়- মানুষ দ্বারা মানুষের জন্য তৈরী করা বিষয়। তাই সংবেদনগুলো সরাসরি তাদের প্রয়োগে তাত্ত্বিক হয়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে জিনিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জিনিসটার খাতিরে, কিন্তু জিনিসটা নিজে নিজের সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে একটা বিষয়গত মানবিক সম্পর্ক, এবং এর উল্টোটাও।* প্রয়োজন অথবা উপভোগ ফলতই তাদের অহমগত স্বভাব হারায় আর প্রকৃতি হারায় এর নিছক উপযোগ, ব্যবহার মানবিক ব্যবহার হওয়ার ফলে।
একই পথে, অন্য মানুষের সংবেদন এবং উপভোগ আমার নিজের যথার্থকরণ হয়ে যায়। তাই এইসব সরাসরি অঙ্গের পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গও সমাজের আঙ্গিকে বিকশিত হয়। যেমন অন্যদের সঙ্গে সরাসরি সম্মিলনে ক্রিয়াকান্ড আমার নিজের জীবন প্রকাশের একটা অঙ্গ, আর মানব জীবনকে যথার্থকরণে একটা ধরণ হয়ে যায়।
এটা স্পষ্ট যে, মানব চক্ষুর জিনিসকে উপভোগ করার পথটা স্থূল ও অমানব চক্ষু হতে ভিন্ন; মানব শ্রবণ স্থূল শ্রবণ হতে ভিন্ন, ইত্যাদি।
আমরা দেখেছি যে, মানুষ কেবল তখনি তার বিষয়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে না যখন বিষয়টা তার জন্য মানব বিষয় বা বিষয়গত মানুষ হয়ে ওঠে। এটা কেবল তখনই সম্ভব যখন বিষয়টি তার জন্য একটা সামাজিক বিষয় হয়ে ওঠে, সে নিজে নিজের জন্য একটা সামাজিক সত্তা হয়ে ওঠে, ঠিক যেভাবে এই বিষয়ে সমাজ তার জন্য এক সত্তা হয়ে ওঠে।
তাই একদিকে যখন সর্বত্র সমাজের মাঝে মানুষের জন্য বিষয়গত জগত মানুুষের প্রামানিক ক্ষমতার জগত হয়ে ওঠে (যা হল মানব বাস্তবতা- এই কারণেই তা তার নিজের প্রামানিক ক্ষমতার বাস্তবতা) কেবল তখনই সব বিষয়ই তার জন্য হয়ে যায় নিজেরই বিষয়করণ, হয়ে যায় সেই বিষয় যা তার স্বতন্ত্রতার উপলব্ধি এবং নিশ্চয়তা বিধান করে। সব বিষয়ই তখন হয়ে যায় মানুষের বিষয় তার মানে, মানুষই নিজে হয়ে ওঠে সেই বিষয়। কিভাবে তারা (সকল বিষয়) তার হয়ে ওঠে তা নির্ভর করে বিষয়ের স্বভাব এবং এর সাথে সম্পৃক্ত প্রামানিক ক্ষমতার স্বভাবের ওপর; কারণ মোদ্দা কথায় এই সম্পর্কের নির্ধারণকারী স্বভাবই অনুমোদনের বিশেষ, বাস্তব ধরণের আকার দেয়। কোন বিষয় চোখের কাছে যা, কানের কাছে অন্য রকম হয়ে ধরা দেয় কানের কাছে কোন বিষয় যা তা আবার চোখের কাছে আরেক রকম। প্রতিটি প্রামানিক ক্ষমতার নির্দিষ্ট চরিত্র সংক্ষেপে এর নির্দিষ্ট সারসত্তা। আর তাই একই সাথে তা এর বিষয়করণের, বিষয়গত ভাবে বাস্তব, জীবন্ত সত্তার নির্দিষ্ট ধরণ। এমনি করে তা বিষয়গত জগতে শুধু চিন্তন ক্রিয়া নয়; তার সব সংবেদন সহ স্বীকৃত হয়।
অপরদিকে, এর বিষয়ীগত প্রেক্ষিতেও এর দিকে তাকানো যাক। ঠিক যেমন সঙ্গীতই কেবল মানুষের মাঝে সঙ্গীতের সংবেদন জাগাতে পারে, আর যেমন মধুরতর সঙ্গীতও সঙ্গীত বেরসিকের কাছে কোন আবেদনই জাগায় না, তা যেমন তার কাছে কোন বিষয়ই [নয়], কারণ কেবল তাই আমার বিষয় হতে পারে যা আমার কোন প্রামানিক ক্ষমতার স্বীকৃতি, অতএব আমার জন্য তা কেবল এমন হতে পারে ততটুকুই যতটুকু আমার প্রামানিক ক্ষমতা নিজের জন্য এক বিষয়ীগত সামর্থ হিসেবে বহাল থাকে। কারণ একটা বিষয় আমার কাছে ততটুকুই মানে ধারণ করে যতটুকু আমার সংবেদন যেতে পারে (বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত সংবেদনের কাছেই কেবল ঐ বিষয়ের কোন মানে থাকে)। একারণেই সামাজিক মানুষের সংবেদন সমূহ অ-সামাজিক মানুষের চাইতে ভিন্ন হয়। মানুষের প্রামানিক সত্তার বিষয়গত নিপাট সমৃদ্ধি কেবল বিষয়ীগত মানব সংবেদন ক্ষমতার সমৃদ্ধিতেই হয় (সঙ্গীতে পাকা কান, সৌন্দর্য বোঝার চোখ- সংক্ষেপে মানব সন্তোষে সক্ষম সংবেদন, মানুষের প্রামানিক ক্ষমতা হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি দেয়া সংবেদন)। তা পরিমার্জিতই হোক অথবা পরিমার্জনক্ষমই হোক। শুধু পাঁচ ইন্দ্রিয়ই নয়, বরং তথাকথিত মানসিক ইন্দ্রিয়- প্রায়োগিক ইন্দ্রিয় (ইচ্ছা, ভালোবাসা ইত্যাদি)- এক কথায়, মানব ইন্দ্রিয়- ইন্দ্রিয় সমূহের মানব স্বভাব- এমন হয়ে ওঠে এর বিষয়ের গুণে, এর মানবায়িত প্রকৃতির গুণে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের গঠন হচ্ছে আজ পর্যন্ত জগতের সমগ্র ইতিহাসের এক শ্রম। স্থুল প্রায়োগিক প্রয়োজনে ধরা পড়া সংবেদন কেবল সীমাবদ্ধ সংবেদন। অনাহারী মানুষের কাছে খাদ্যের কোন মানবিক আঙ্গিক অস্তিত্বশীল থাকে না, বরং সেখানে খাদ্য হিসেবে এর অমূর্ত অস্তিত্বই বিরাজমান থাকে। খাদ্য সেখানে কেবল এর স্থূলতম আঙ্গিকেই থাকতে পারে, সেখানে এই খাদ্যগ্রহণ ক্রিয়া পশুদের থেকে ভিন্ন কি না তা বলা সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগে ভেঙে পড়া, দারিদ্র পীড়িত মানুষের কাছে নিপুণ কলা কোন বোধই ধারণ করেনা। খনিজ মজুতদারেরা শুধু খনিজের ব্যবসায়িক মূল্যই বোঝে, এর সৌন্দর্য বা বিশেষ চরিত্র তার চোখে পড়ে না : তার কোন খনিজবিদ্যাগত বোধ নেই। এভাবে, মানুষের সংবেদনকে মানবিক করে তুলতে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক উভয় পটভূমিতেই মানব সারসত্তার বিষয়করণ প্রয়োজন। একই সাথে প্রয়োজন মানবিক এবং প্রাকৃতিক সার উপাদানের সমগ্র সম্পদের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে মানব সংবেদনকে সৃষ্টি করা।
<ব্যক্তি সম্পত্তির সঞ্চালন, এর সম্পদ আর পাশাপাশি এর দূর্দশা- এর বস্তুগত ও মরমী সম্পদ ও দূর্দশার মধ্য দিয়ে মুকুলিত সমাজ এই বিকাশের জন্য সব মালমশলা হাতে পেয়ে যায়। ঠিক এমনিভাবেই প্রতিষ্ঠিত সমাজ মানুষকে তার সত্তার সমস্ত সমৃদ্ধি দিয়ে উৎপন্ন করে- ধনী মানুষকে উৎপন্ন করে সমগ্র সংবেদন দিয়ে যত্ন করে সাজিয়ে গুছিয়ে- সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতার হিসেবে।>
আমরা দেখছি কেমন করে বিষয়ীবাদ এবং বিষয়বাদ, মরমীবাদ এবং বস্তুবাদ, ক্রিয়া এবং দূর্ভোগ কেবল তাদের প্রতিনয়ী চরিত্র হারায়। আর তাই সমাজকাঠামোর মাঝে ঐরকম প্রতিনয় হিসেবে তাদের অস্তিত্বও হারায়। আমরা দেখছি তাত্ত্বিক প্রতিনয়টির সমাধান কিভাবে কেবল একটা হাতে- কলমের পথে, মানুষের প্রায়োগিক কর্মদক্ষতার গুণেই সম্ভব। তাই তাদের সমাধান শুধুমাত্র বোধগম্যতার সমস্যা নয়। এটি জীবনের এক বাস্তব সমস্যা, শুধু দর্শন তার সমাধান করতে পারে না। সংক্ষেপে এর কারণ হল, দর্শন সমস্যাটিকে নিছক তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে ধারণা করে।
আমরা দেখছি কিভাবে শিল্পের ইতিহাস ও শিল্পের প্রতিষ্ঠিত বিষয়গত অস্তিত্ব মানুষের প্রামানিক ক্ষমতার এক খোলা বই, সংবেদনগ্রাহ্যভাবে অস্তিত্বমান মানব মনবিদ্যা । এখন পর্যন্ত একে মানুষের প্রামানিক সত্তার সাথে সংযুক্ত করে ধারণা করা হয়নি। একে ধারণা করা হয়েছে শুধু উপযোগের এক বাহ্যিক সম্পর্ক দিয়ে। কারণ বিচ্ছিন্নতার রাজ্যে বিচরণকালে, জনগণ কেবল মানুষের সত্তার সাধারণ ধরণ নিয়ে ভাবতে পারে, যেমন ধর্ম বা ইতিহাসকে রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি হিসেবে এর অমূর্ত- সাধারণ চরিত্রে- মানুষের প্রামানিক ক্ষমতা এবং মানুষের প্রজাতি ক্রিয়াশীলতা হিসেবে। আমাদের সম্মুখে রয়েছে মানুষের বিষয়কৃত প্রামানিক ক্ষমতা, সংবেদনক্ষম, বিজাতীয়, প্রয়োজনীয় বিষয়ের আঙ্গিকে, সাধারণ বস্তুগত শিল্পে(ঐশধয়ড়ঢ়ক্ষঁ) প্রদর্শিত বিচ্ছিন্নতার আঙ্গিকে (যাকে ধারণা করা যায় সেই সাধারণ সঞ্চালনের অংশ হিসেবে। নয়তো সেই সঞ্চালনকে ধারণা করা যায় শিল্পের একটা বিশেষ অংশ হিসেবে, যেহেতু এখন পর্যন্ত সব মানব ক্রিয়াশীলতা হল নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শ্রম- মানে শিল্প)।
যে মনোবিদ্যার কাছে সবচেয়ে প্রত্যক্ষণযোগ্য এবং অভিগম্য আঙ্গিকে বহাল থাকা ইতিহাসের অংশটাই একটা বন্ধ বই হয়ে থেকে যায় তা আসল, বোধগম্য এবং বাস্তব বিঞ্চান হয়ে উঠতে পারে না। যে বিঞ্চান মানব শ্রমের এই বিশাল অংশ হতে হাওয়াই ভাবে অমূর্তায়ন করে, যে বিঞ্চান নিজের অসম্পূর্ণতা বুঝতে অক্ষম, তাকে নিয়ে আসলে আমরা কি ভাববো- যখন মানব প্রচেষ্টার এমন এক সম্পদ তার সামনে অনাবৃত হয়ে পড়ে আছে, তবু এত কিছু তার কাছে কোন মানেই রাখে না। তাহলে জ্ঞপ্রয়োজনঞ্চ, জ্ঞস্থুল প্রয়োজনঞ্চ, এমন একটা কথায় কি-ই বা প্রকাশিত হতে পারে?
প্রাকৃতিক বিঞ্চান বিকশিত করেছে ব্যাপক ক্রিয়াশীলতা, একীভূত করেছে এক সর্বদাই বাড়ন্ত মালমশলার সমষ্টি। তার পরো দর্শন যতটা তাদের কাছে বিজাতীয় হয়ে আছে, তারাও দর্শনের কাছে ততটাই বিজাতীয় হয়ে আছে। তাদের ক্ষণিক ঐক্য ছিল কেবল এক কিম্ভূত মায়া । ইচ্ছেটা ছিল, কিন্তু ক্ষমতায় ছিল ঘাটতি। ইতিহাসবিদ্যা নিজে কখনো সখনো প্রকৃতি বিঞ্চানের ধার ধেরেছে, আলোকায়নের উপযোগের একটা ঘটনা শর্ত হিসেবে, আর বিশেষ কোন বড় আবিষ্কার হিসেবে। কিন্তু প্রকৃতি বিঞ্চান শিল্পের(ঐশধয়ড়ঢ়ক্ষঁ) মাধ্যমে মানবজীবন প্রায়োগিকভাবে আগ্রাসিত আর রূপান্তরিত করেছে। যদিও এর তাৎক্ষণিক প্রভাব মানুষের অমানুষ করার প্রক্রিয়াকেই নেয়, তবু তা মানব মুক্তিই প্রস্তুত করেছে। শিল্প হচ্ছে মানুষের সাথে প্রকৃতির (আর তাই প্রকৃতি বিঞ্চানের) বাস্তব, ঐতিহাসিক সম্পর্ক। তাই যদি শিল্পকে ধারণা করা হয় মানুষের প্রামানিক ক্ষমতার জনবোধগম্য প্রকাশ বলে, তাহলে আমরা প্রকৃতির মানবিক সারসত্তা বা মানুষের প্রাকৃতিক সারসত্তা সম্পর্কেও একটা বোধ লাভ করি। এর ফলে প্রকৃতি বিঞ্চান এর অমূর্তায়িত মালমশলা বা আরো পরিষ্কার করে বললে ভাববাদী প্রবণতা হারাবে, আর হয়ে উঠবে মানব বিঞ্চানের ভিত্তি। এর মধ্যেই এমনটা হয়ে উঠেছে, যদিও তা হয়েছে একটা বিচ্ছিন্ন আঙ্গিকে- বাস্তব মানব জীবনের ভিত্তিতে। আর জীবনের জন্য এক, বিঞ্চানের জন্য আরেক ভিত্তি ধরে নেয়া- কাজ চালানোর ধারার হিসেবে একটা মিথ্যুক প্রস্তাবনা। <মানব ইতিহাসে বিকশিত প্রকৃতি- মানব সমাজের উৎপত্তি হল- মানুষের বাস্তব প্রকৃতি; যেহেতু শিল্পের মাঝে প্রকৃতি যে হিসেবে বিকশিত হয়; বিচ্ছিন্ন আঙ্গিকে হলেও তা আসল নৃ-তাত্ত্বিক প্রকৃতি।>
সমস্ত বিঞ্চানের ভিত্তি অবশ্যই হওয়া উচিত সংবেদন-প্রত্যক্ষণ (ফয়েরবাখ দেখুন)। একমাত্র যখন তা সংবেদন-প্রত্যক্ষণ হতে দ্বিভাজিত আঙ্গিকে যাত্রা করে (সংবেদনগত চৈতন্য এবং সংবেদনগত প্রয়োজন)- মানে তা যখন কেবল প্রকৃতি হতে যাত্রা করে তখনি তা হয় বাস্তব বিঞ্চান। সকল ইতিহাসই সংবেদনগত চৈতন্যের বিষয় হয়ে ওঠার জন্য জ্ঞমানুষেরঞ্চ প্রস্তুতি আর বিকাশের এবং জ্ঞমানুষ হিসেবে মানুষঞ্চ এর প্রয়োজনগুলো তার অভাবে পাল্টে নেবার ইতিহাস। ইতিহাস নিজে প্রাকৃতিক ইতিহাসের- মানুষের মাঝে বিকাশমান প্রকৃতির এক বাস্তব অংশ। সময়ে প্রকৃতি বিঞ্চান নিজের মাঝে মানুষের বিঞ্চানকে অঙ্গীভূত করবে, ঠিক যেমন মানুষের বিঞ্চান নিজের মাঝে অঙ্গীভূত করবে প্রকৃতি বিঞ্চানকে, থাকবে শুধু একটা একক বিঞ্চান।
মানুষ হচ্ছে প্রকৃতি বিঞ্চানের প্রত্যক্ষ বিষয়; কারণ মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ, সংবেদনগত প্রকৃতি হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে, মানব সংবেদনশীলতা (প্রকাশটি অভিন্ন)। তা উপস্থাপিত হয় তার কাছে সংবেদনগত ভাবে উপস্থিত প্রত্যক্ষভাবে অন্য মানুষের আঙ্গিকে। আদতে তার নিজের সংবেদনশীলতা প্রথমে অস্তিত্বমান অন্য মানুষের মাধ্যমে তার নিজের জন্য মানব সংবেদনশীলতা হিসেবে। কিন্তু প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের বিঞ্চানের প্রত্যক্ষ বিষয় : মানুষের প্রথম বিষয়- মানুষ হচ্ছে প্রকৃতি। সংবেদনশীলতা, প্রামানিক ক্ষমতা তাদের আত্ম-বোধ খুঁজে পেতে পারে কেবল সাধারণভাবে প্রকৃতি জগতের বিঞ্চানের মাঝে। চিন্তার উপাদান- চিন্তার জীবন্ত উপাদানের প্রকাশ সে ভাষা যে নিজেই সংবেদনগত প্রকৃতির। প্রকৃতির সামাজিক বাস্তবতা, আর মানব প্রকৃতি বিঞ্চান, অথবা মানুষ সম্বন্ধে প্রকৃতি বিঞ্চান হল অভিন্ন পদ।
<এবার দেখা যাবে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সম্পদ আর দারিদ্রের স্থানে কিভাবে ধনী মানব সত্তা আর সমৃদ্ধ মানব অভাব এসে হাজির হয়। ধনী মানবসত্তা যুগপৎভাবে সেই মানব সত্তা যে জীবনের মানবিক প্রকাশের এক সমগ্রতার অভাবে রয়েছে- যে মানুষের মাঝে তার নিজের উপলব্ধি এক ভেতরকার প্রামানিক হিসেবে, অভাব হিসেবে অস্তিত্বমান। সমাজতন্ত্রের(১৪) ধারণাতে- কেবল সম্পদ নয়, বরং একই ভাবে মানুষের দারিদ্রও সমান পরিমাপে এক মানব আর তাই সামাজিক তাৎপর্য পায়। দারিদ্র হচ্ছে সেই পরোক্ষ বন্ধন যা মানব সত্তাকে বৃহত্তম সম্পদ- অন্য মানব সত্তার অভাবের অভিঞ্চতা ঘটায়। আমার মাঝে বিষয়গত সত্তার রাজত্ব, আমার জীবন ক্রিয়াশীলতার সংবেদনগত বিস্ফোরণ হল আবেগ । এভাবে, এই আবেগই এখানে হয়ে ওঠে আমার সত্তার ক্রিয়াশীলতা।>
(৫)একটা সত্তা কেবল তখনি নিজেকে স্বাধীন বিবেচনা করতে পারে যখন সে নিজের পায়ে দাঁড়ায়। আর কেবল তখনি সে নিজের পায়ে দাঁড়ায় যখন সে তার অস্তিত্বের জন্য নিজের কাছেই ঋণী থাকে। যে মানুষ অন্যের মহিমায় বেঁচে থাকে, সে নিজেকে নির্ভরশীল হিসেবে বিবেচনা করে। আমার খরপোষের সাথে সাথে যদি আমার জীবন সৃষ্টির জন্য, আমার জীবনের উৎস হবার জন্য আমাকে অন্য কারুর কাছে ঋণী থাকতে হয়, তবে তো আমি পুরোপুরিই অন্যের মহিমায় বেঁচে আছি। আমার জীবন যদি আমার নিজের সৃষ্টি না হয়, তাহলে অবশ্যই তার এই ধরণের উৎস তার বাইরে কোথাও। এই সৃষ্টি তাহলে এমন এক ব্যাপার যাকে লোকায়ত চৈতন্য থেকে ঠাঁই ছাড়া করা খুব কঠিন। প্রকৃতি এবং মানুষ নিজের হিসেবে বহাল থাকে- এই ঘটনা শর্তটি তাদের মাথায় ঢোকে না, কারণ যা কিছু প্রায়োগিক জীবনে ধরা ছোঁয়া যায় তার সাথে একথা মেলে না।
ভূ-তত্ত্ব বিঞ্চান পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্বকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে (মানে সে বিঞ্চান যা পৃথিবীর গঠন ও বিকাশকে এক প্রক্রিয়ার রূপে, স্ব-উৎপন্ন হিসেবে উপস্থাপন করে)। এই ভূ-তত্ত্ব বিঞ্চানই সৃষ্টিতত্ত্বের একমাত্র প্রায়োগিক খন্ডন।(১৫)
তুমি তোমার বাবা মা হতে জন্মিয়েছো; তাই তোমার মাঝে দুটো মানব সত্তার মিলিত রূপ আছে- মানব সত্তাগুলোর এক প্রজাতি ক্রিয়া মানব সত্তাটি উৎপন্ন করেছে : আগেই বলা এরিস্টটলের এই কথাগুলো কোন একজন স্বতন্ত্রকে বলা নিশ্চয়ই সহজ। তাহলে দেখো, এমন কি শরীরগত দিকে মানুষ তার অস্তিত্বের জন্য মানুষের কাছে ঋণী। তাহলে তোমার কেবল সেই অসীম অগ্রসরণের এক প্রেক্ষিতের দিকে নজর দিলেই চলবে না যা তোমাকে কেবল এই অনুসন্ধানেই ব্যাপ্ত রাখবে যে : আমার বাবাকে কে জন্ম দিলো? তার পিতামহকে কে? এইসব। তোমাকে অবশ্যই সেই প্রগতির চক্রাকার সঞ্চালনের সংবেদনগত প্রত্যক্ষণটির দিকে নজর রাখতে হবে যার দ্বারা মানুষ প্রজননে নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। মানুষ এভাবে সর্বদাই বিষয়ী হয়ে রয়ে যায়। যা হোক, তুমি জবাব দেবে : তোমার এই চক্রাকার সঞ্চালনের ব্যাপার মেনে নিলাম। এখন আমি যা ভেবে প্রশ্ন করি যে প্রথম মানুষ আর সমগ্র প্রকৃতিকে কে জন্ম দিল- তুমি আমার এই ব্যাপারটাও মেনে নাও। তাহলে আমি তোমাকে কেবল একটাই উত্তর দিতে পারি : তোমার প্রশ্নটা নিজেই অমূর্তায়নের এক উৎপন্ন। নিজেকেই প্রশ্ন করো- তুমি কেমন করে এই প্রশ্নে পৌঁছলে। নিজেকে জিঞ্চেস করো, তোমার প্রশ্ন কি এমন এক অবস্থান থেকে করা হয়নি আমি যার জবাব দিতে পারি না, কারণ তা করাই হয়েছে ভুল ভাবে। নিজেকে প্রশ্ন করো এমন রকম প্রশ্নের যৌক্তিক মনে কোন অস্তিত্ব আছে কি না। যখন তুমি মানুষ এবং প্রকৃতির সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রশ্ন করছো, তা করে তুমি মানুষ এবং প্রকৃতি হতে অমূর্তায়ন করছো। তুমি তাদের অনস্তিত্ব হিসেবে স্বীকার্যায়িত করছো আর আমার কাছেই তাদের অস্তিত্বশীলতার প্রমাণ চাইছো! এখন আমি তোমায় বলি : তোমার অমূর্তায়নটা বাদ দাও, তাহলে তোমার প্রশ্নটাও বাদ যাবে। অথবা তুমি যদি অমূর্তায়নটাই আঁকড়ে থাকতে চাও তো মাথা ঠান্ডা কর আর তুমি যদি মানুষ ও প্রকৃতিকে অনস্তিত্বশীল বলে ভাবো তো নিজেকেও তাই ভেবে নাও; কারণ তুমিও নিশ্চয়ই প্রকৃতি ও মানুষ। ভেবো না, আমাকে প্রশ্নও করো না। কারণ যখনি তুমি ভাবো আর প্রশ্ন করো, তখনি মানুষ আর প্রকৃতির অস্তিত্ব হতে তোমার অমূর্তায়ন অর্থহীন হয়ে যায়। অথবা তুমি কি এমনি অহংবাদী যে সব কিছুকে কিছুই না ভেবেও নিজে বহাল থাকতে চাও?
তুমি জবাব দিতে পারো : আমি প্রকৃতির জ্ঞকিছুই নাঞ্চ ভাবটাকে স্বীকার্যায়িত করতে চাই না, ইত্যাদি। আমি তোমার কাছে এর উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি, যেমন আমি অস্থিবিদের কাছে হাড়ের গঠন সম্পর্কে জানতে চাই।
একজন সমাজতন্ত্রী মানুষের কাছে তথাকথিত সমগ্র জগত ইতিহাস মানবশ্রমের মাধ্যমে মানুষের নিজেকে সৃষ্টি, মানুষের জন্য প্রকৃতির বিকশিত হওয়া ছাড়া কিছুই না। তাই তার কাছে তার উৎপত্তির, নিজের মাধ্যমেই তার জন্মের দৃশ্যমান, অখন্ডনীয় প্রমাণ আছে। যেহেতু মানুষ এবং প্রকৃতির বাস্তব অস্তিত্ব, প্রকৃতির সত্তা হিসেবে মানুষ মানুষের কাছে এবং মানুষের সত্তা হিসেবে প্রকৃতি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে হাতে- কলমের, সংবেদনগত, প্রত্যক্ষণযোগ্য- সেহেতু কোন বিজাতীয় সত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন, প্রকৃতি এবং মানব উর্ধ্ব কোন সত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন করা মানে প্রকৃতি এবং মানুষের অবাস্তবতাকে মেনে নেয়া বোঝায়। প্রশ্নটি প্রয়োগে অসম্ভব হয়ে গেছে। এই অবাস্তবতার অস্বীকৃতি হিসেবে নাস্তিকতা আর কোন অর্থ বহন করে না, কারণ নাস্তিকতা হচ্ছে ঈশ্বরের নেতিকরণ, আর এই নেতিকরণের মাঝ দিয়েই মানুষের অস্তিত্ব স্বীকার্য করে নেয়া। কিন্তু সমাজতন্ত্র হিসেবে সমাজতন্ত্রের আর এমন কোন ঘুর পথের দরকার হয় না। সে সারসত্তা হিসেবে মানুষ এবং প্রকৃতির তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক সংবেদনগত চৈতন্য হতে যাত্রা শুরু করে। সমাজতন্ত্র হল মানুষের সদার্থক আত্ম-চৈতন্য, যার আর ধর্মকে উৎখাত করার মধ্যস্থতার দরকার পড়ে না। ঠিক যেমন বাস্তব জীবন হল কমিউনিজমের মাধ্যমে মানুষের সদার্থক বাস্তবতা যা আর ব্যক্তি সম্পত্তি উৎখাতের মধ্যস্থতাকৃত নয়। নেতিকরণের নেতিকরণ হিসেবে কমিউনিজম হল সদার্থক ধরণ আর তাই তা সেই বাস্তব স্তর যা প্রয়োজন মানব মুক্তি এবং পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াতে ঐতিহাসিক বিকাশের পরবর্তী স্তরের জন্য। কমিউনিজম হল তাৎক্ষণিক ভবিষ্যতের আবশ্যকীয় আঙ্গিক এবং গতিশীল নীতি, কিন্তু এমন কমিউনিজম মানব বিকাশের লক্ষ্য, মানব সমাজের আঙ্গিক নয়।(১৬)

পরবর্তী অংশ