Marxists Internet Archive
Bangla Section


জার্মান ভাবাদর্শ

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

ভাবাদর্শের বাস্তব ভিত্তি
ক. মেলামেশা এবং উৎপাদনী ক্ষমতা

বস্তুগত আর মানসিক শ্রমের সবচেয়ে বড় বিভক্তি হচ্ছে শহর আর গ্রামের পৃথকীকরণ। শহর আর গ্রামের শত্রুতা শুরু হয় বর্বরতা থেকে সভ্যতায়, গোত্র থেকে রাষ্ট্রে, এলাকা থেকে জাতিতে উত্তরণের মাধ্যমে, আর এই শত্রুতা সভ্যতার পুরো ইতিহাস থেকে আজ অবধি চলছে (এন্টি কর্ণ ল লীগ)। শহরের অস্তিত্ব মানেই একই সময়ে প্রশাসন, পুলিশ, কর ইত্যাদি, সংক্ষেপে আত্মনিয়ন্ত্রিত শহরের অস্তিত্ব আর এভাবে সাধারণভাবে রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা। এখানে প্রথম সরাসরিভাবে শ্রম বিভাগ আর উৎপাদনের উপকরণের উপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার দুটো বিরাট ভাগে বিভক্তি প্রদর্শিত হয়। শহর ইতঃমধ্যে হয়ে যায় জনসংখ্যার ঘনীভবন, পুঁজি, প্রমোদ, চাহিদা আর উৎপাদনের উপকরণের জমাটত্ব, যখন গ্রাম দেখায় উল্টো ঘটনা- তাদের একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতা। শহর আর গ্রামের লড়াই বহাল থাকতে পারে কেবল ব্যক্তি সম্পত্তির ফলাফল হিসেবে। এটা স্বতন্ত্রদের শ্রম বিভাগের অধীনে, তাদের উপর চাপিয়ে নির্দিষ্ট কাজের অধীন বশ্যতার সবচাইতে ঘন থকথকে প্রকাশ, যা এক মানুষকে বানায় শর্তাবদ্ধ শহুরে জন্তু, অপরকে করে শর্তাবদ্ধ গ্রাম্য জন্তু; আর প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে স্বার্থের নিত্যনতুন সংঘাত লাগায়। এখানে আবার শ্রম প্রধান জিনিস, স্বতন্ত্রদের উপর শক্তি, আর যতক্ষণ পরেরটি বহাল থাকবে ব্যক্তিসম্পত্তিও অবশ্যই বহাল থাকবে। শহর এবং গ্রামের শত্রুতার এই বিলোপ জনসম্প্রদায় জীবনের প্রথম শর্ত। এটা এমন এক শর্ত যা আবার নির্ভর করে একগাদা বস্তুগত প্রাকসিদ্ধান্তের উপর আর যা নিছক ইচ্ছা দিয়ে পূরণ করা যায় না- যেমন যে কেউ প্রথম নজরেই দেখতে পাবে। (এই শর্তগুলো এখনো গুনে শেষ করা বাকি আছে।) শহর এবং গ্রামের আলাদা হয়ে যাওয়াকে পুঁজি আর ভূমিগত সম্পদের পৃথকীকরণ, ভূমিগত সম্পত্তি থেকে স্বাধীন পুঁজির অস্তিত্ব এবং বিকাশ এর সূচনা হিসেবেও বোঝা যায়- বোঝা যায় শুধুমাত্র শ্রম আর বিনিময়ের উপর থাকা সম্পত্তির শুরু হিসেবে।
মধ্যযুগে যে সব শহর আগে তৈরী নয় বরং মুক্তিপ্রাপ্ত ভূমিদাসদের দ্বারা নতুন গঠিত, সেখানে প্রতিটি মানুষের সাথে আনা ছোট পুঁজি- মানে ঘরোয়া শিল্পের একেবারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া তাদের নিজস্ব বিশেষ শ্রমই ছিল একমাত্র সম্পদ। নিরন্তর শহরে পালিয়ে আসতে থাকা ভূমিদাসদের প্রতিযোগিতা, শহরের বিরুদ্ধে গ্রামের লাগাতার যুদ্ধ আর এভাবে একটি সংগঠিত পৌর সামরিক প্রয়োজনীয়তা, নির্দিষ্ট এক টুকরো কাজে সাধারণ মালিকানার বন্ধন, যখন কারিগরই ব্যবসায়ী তখন তাদের পোশাক বিক্রির জন্য সাধারণ স্থাপনার প্রয়োজনীয়তা, আর এই সব স্থাপনা থেকে যারা অনুমোদিত নয় তাদের ধারাবাহিক বহিষ্কার, বিভিন্ন ঘরোয়া শিল্পের স্বার্থের সংঘাত, অনেক কষ্টে পাওয়া তাদের দক্ষতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং সমস্ত গ্রামের সামন্তীয় সংগঠন : প্রতিটি ঘরোয়া শিল্পের শ্রমিকদের গিল্ডে ঐক্যবদ্ধ হবার এই ছিল কারণ। পরবর্তী ঐতিহাসিক বিকাশের মাঝ দিয়ে গিল্ড পদ্ধতির বহুধা বিকাশে যাবার দরকার আমাদের এইখানে নেই।
ভূমিদাসদের শহরে উড়াল অব্যাহতভাবে চলেছে মধ্যযুগ জুড়ে। গ্রামে তাদের কর্তাদের দ্বারা নিগৃহীত এই ভূমিদাসেরা আলাদাভাবে শহরে বসে পড়ে। শহরে তারা দেখতে পায় এক সংগঠিত গোষ্ঠী যার বিরুদ্ধে তারা শক্তিহীন, যার মাঝে তাদের শ্রমের চাহিদা এবং সংগঠিত শহুরে প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্বার্থ দ্বারা প্রদত্ত নির্দিষ্ট স্থানের অধীন হতে তারা বাধ্য হয়। আলাদাভাবে ঢোকায় এই শ্রমিকেরা কখনো কোন শক্তিতে পৌঁছতে পারেনি, যেহেতু, তাদের শ্রম যদি হয় গিল্ড ধরণের, যা শিখতে হয়, তখন তো গিল্ড মাস্টার ঐ শ্রমিকদের তার ইচ্ছেমতো বুঝতে বাধ্য করতো আর তাদের নিজ স্বার্থ অনুযায়ী সংগঠিত করতো। আর তাদের কাজ যদি শিখতে না হত, তাই তা যদি গিল্ড ধরণের না হত, তাহলে তারা হয়ে পড়তো দিনমজুর, কখনোই সংগঠিত হয়ে উঠতে পারতো না, রয়ে যেত অসংগঠিত একটা হুড়োহুড়ি হয়ে।
শহুরে দিনমজুরীর চাহিদা তৈরী করেছিল এই হুড়োহুড়ি। এই শহরগুলো ছিল সম্পদ রক্ষা, উৎপাদনের উপায় বহুগুণ করা আর আলাদা সদস্যদের প্রতিরক্ষায় প্রয়োজনের খাতিরে সরাসরি নির্ভেজাল সংঘ। শহরগুলোর এই হুল্লোড় ছিল যে কোন ধরণের ক্ষমতাহীন, আলাদাভাবে আসা মানুষদের দিয়ে এমনভাবে তৈরী যেন তারা একে অপরের কাছে আগন্তুক। যারা দাঁড়িয়ে ছিল যুদ্ধের জন্য সজ্জিত সংগঠিত এক বাহিনীর বিপরীতে অসংগঠিত হয়ে, তাকিয়ে ছিল ঈর্ষা ভরে। ওস্তাদের স্বার্থ সবচাইতে ভালো যেভাবে রক্ষিত হয়, প্রতিটি ঘরোয়া শিল্পে ঠিকামজুর এবং নবীশদের এমনভাবেই সংগঠিত থাকতে হত। ওস্তাদদের সাথে তাদের এই কুশ্রী সম্পর্ক ওস্তাদদেরকে দ্বিগুণ ক্ষমতা দিল- একদিকে কারণ ঠিকামজুরদের পুরো জীবনে তাদের প্রভাব, অপরদিকে কারণ একই ওস্তাদদের অধীনে কাজ করা ঠিকা মজুরদের কাছ থেকে আলাদা করে তাদের বিরুদ্ধে এক করে রাখতো। আর চূড়ান্ত বিচারে ঠিকে মজুরেরা নিজেই ওস্তাদ হবার সরল স্বার্থে বহাল অবস্থার সাথে আবদ্ধ ছিল। তাই যখন ঐ হুল্লোড় অন্ততঃ পুরো স্বায়ত্বশাসিত শহরের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতো- যে বিদ্রোহ তাদের শক্তিহীনতার কারণে কোন প্রভাবই ফেলতো না, তখন ঠিকে মজুরেরা বিচ্ছিন্ন গিল্ডগুলোতে ছোটখাট বশ্যতা অস্বীকারের বেশি এগোয়নি। এরকমটা গিল্ডের একেবারে স্বভাবের ভেতরেই পড়ে। মধ্যযুগের বিশাল অভ্যুত্থানগুলো সবই গ্রাম থেকে বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু চাষাদের বিচ্ছিন্নতা আর তার সাথের আকাটপনার কারণে তা রয়ে গেল সমানরকম ভাবে একেবারে প্রভাবহীন।
শহরগুলোতে স্বতন্ত্র গিল্ডগুলোর মাঝে শ্রমবিভাগ ছিল একেবারে স্বাভাবিক(৩৩) আর গিল্ডগুলোর পরস্পরের মধ্যে স্বতন্ত্র শ্রমিকদের মাঝে তা ততটা বিকশিত হয়নি। তখন প্রতিটি শ্রমিককে নানা রকমের কাজে দক্ষ হতে হত। তার যন্ত্রপাতি দিয়ে যা যা বানানো যায় তার সব বানাতে জানতে হত। সীমাবদ্ধ বাণিজ্য এবং স্বতন্ত্র শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগের স্বল্পতা, জনসংখ্যার ঘাটতি এবং ক্ষুদ্র চাহিদা উঁচু শ্রমবিভাগ অনুমোদন করত না। আর তাই ওস্তাদ হতে ইচ্ছুক প্রতিটি মানুষকে তার ঘরোয়া শিল্পের পুরোটাতে দক্ষ হতে হত। এভাবে মধ্যযুগের কারু শ্রমিকদের মাঝে নিজেদের বিশেষায়িত কাজের প্রতি এবং এতে পারদর্শিতা অর্জনের আগ্রহ দেখা যায় যা ক্ষুদ্র পরিমাণে নান্দনিক ধারণা তৈরীতে সমর্থ হয়। এই কারণের জন্যই মধ্যযুগের প্রতিটি কারুশ্রমিক তার কাজে একেবারে ডুবে থাকত, যে কাজের সাথে সম্পর্ক ছিল তৃপ্তিমূলক আর দাসসুলভ। বর্তমান শ্রমিকের তুলনায় ঐ কাজের প্রতি তার অধীনস্ততা ছিল অনেক বেশি। বর্তমান শ্রমিকের জন্য তার কাজটা অবিচ্ছিন্ন একটা কিছু।
এইসব শহরগুলোতে পুঁজি ছিল ঘর, কারুশিল্পের যন্ত্রপাতি, আর স্বাভাবিক, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খরিদ্দারের সমন্বয়ে স্বাভাবিক পুঁজি। পেছনে পড়ে থাকা বাণিজ্য আর সঞ্চালনের ঘাটতির কারণে বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই পুঁজি চলে এসেছে পিতা থেকে পুত্রে। অর্থে মাপা যাওয়া, অবিচ্ছিন্নভাবে যেখানে সেখানে বিনিয়োগ করতে পারা আধুনিক পুঁজির মতো না হয়ে ঐ পুঁজি ছিল মালিকের বিশেষ কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত, তার সাথে অবিচ্ছেদ্য আর এই সীমা পর্যন্ত ভূসম্পত্তিগত পুঁজি।(৩৪) শ্রম বিভাগের পরবর্তী বিস্তৃতিটি ছিল উৎপাদন ও বাণিজ্যের আলাদা করা, একটি বিশেষ শ্রেণীর বণিক গড়ে উঠায়। এই বিচ্ছিন্নতাটি ছিল শহরে পূর্বতন যুগের দ্বারা ছেড়ে যাওয়া, হাতে তুলে দেয়া (ইহুদীদের দেয়া অন্যান্য জিনিসের সাথে) আর তা খুব শিগ্‌গির নতুন একটা আঙ্গিকে আবির্ভূত হয়। এর মাধ্যমে একেবারে কাছের প্রতিবেশীদের ছাড়িয়েও এমন একটা বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরী হল যার বাস্তবায়ন নির্ভর করে যোগাযোগের বহাল উপকরণ, গ্রামাঞ্চলে জননিরাপত্তার দশা, যা নির্ধারিত রাজনৈতিক অবস্থা দিয়ে (সবার জানা আছে যে, সারা মধ্যযুগ জুড়ে বণিকেরা সশস্ত্র ক্যারভানে করে চলতেন), মেলামেশার আয়ত্বে থাকা এলাকার আকাট বা আরো অগ্রগামী চাহিদার উপর (যা নির্ধারিত হয় অর্জিত সংস্কৃতি দশা দিয়ে)। বাণিজ্যের সাথে একটি বিশেষ শ্রেণীর বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে, শহরের আশপাশ ছাড়িয়ে বণিকদের মাধ্যমে বাণিজ্যের বিস্তৃতির সাথে তাৎক্ষণিকভাবে উৎপাদন আর বাণিজ্যের মধ্যে একটি পারস্পরিক ক্রিয়া আবির্ভূত হয়। শহরগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কে প্রবেশ করে, এক শহর থেকে আরেক শহরে নতুন হাতিয়ার আনা হয়, আর উৎপাদন এবং বাণিজ্যের মাঝে পৃথকীকরণ শীঘ্রই ডেকে আনে স্বতন্ত্র শহরগুলোর মাঝে উৎপাদনের একটি নতুন বিভাজন, যার প্রত্যেকটি শীঘ্রই পূর্ব আধিপত্যকারী শিল্পশাখা শোষণ করতে শুরু করে। আগের সময়ের বিধি নিষেধগুলো ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়তে থাকে।
মধ্যযুগে প্রতিটি শহরের নাগরিকরা তাদের চামড়া বাঁচানোর জন্য ভূমিমালিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে এক হতে বাধ্য হয়। ব্যবসার বিস্তৃতি, যোগাযোগের প্রতিষ্ঠা আলাদা শহরগুলোকে অন্য শহরকে জানার সুযোগ দেয়, যে শহরগুলো একই প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একই স্বার্থ বিবৃত করে। বার্ঘারদের বহু স্থানীয় আইনী প্রতিষ্ঠান হতে ক্রমান্বয়ে কেবল বার্ঘার শ্রেণী উঠে আসে। স্বতন্ত্র বার্ঘাররা হয়ে উঠে জীবনের শর্ত, বহাল সম্পর্ক এবং তার দ্বারা নির্ধারিত শ্রমের ধরণের সাথে তাদের লড়াইয়ের হিসেবে। এই শর্তগুলো ছিল তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য এবং প্রত্যেক স্বতন্ত্র হতে স্বাধীন। যতদূর পর্যন্ত বার্ঘাররা সামন্ত বাঁধন থেকে ছিঁড়ে বের করতে পেরেছে ততটুকুই তারা এই শর্ত তৈরী করতে পেরেছে, তাদের বহাল পাওয়া সামন্ত ব্যবস্থার সাথে তাদের লড়াইয়ে তারা যতটা নির্ধারিত হতে পেরেছিল তাদের দিয়ে ততটুকুই শর্ত সৃষ্টি হয়েছিল।
যখন স্বতন্ত্র শহরগুলো সংঘে আসতে শুরু করে তখন সাধারণ শর্তগুলো শ্রেণী শর্তে বিকশিত হয়। একই অবস্থা, একই লড়াই, একই স্বার্থ তাদেরকে উপনীত করে সর্বত্র সামগ্রিকভাবে এক প্রথায়। বুর্জোয়ারা নিজেও তাদের শর্তের সাথে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়। তারা বিকশিত হয় শ্রম বিভাগ অনুসারে বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত হয়ে এবং পরিশেষে পূর্ববর্তী সকল মালিক শ্রেণীকে গ্রাস করে (যখন এটি পূর্বের অ-মালিক শ্রেণীর সিংহভাগ এবং মালিক শ্রেণীর একটা অংশকে প্রলেতারিয়েত নামে নতুন শ্রেণীতে বিকশিত করে) যে মাপে সকল পূর্বতন সম্পত্তি শিল্প বা বাণিজ্য পুঁজিতে রূপান্তরিত হয় সেই মাপে। যতদূর পর্যন্ত অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে সাধারণ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে ততদূরই আলাদা স্বতন্ত্রেরা একটা শ্রেণী তৈরী করে; অন্যথায় তারা প্রতিদ্বন্দ্বীর মত হিংসা-বিবাদে লিপ্ত থাকে।
অপরদিকে, নিজেরা বেলায় শ্রেণীটি স্বতন্ত্রদের উপর স্বাধীন অস্তিত্ব অর্জন করে, যাতে স্বতন্ত্রেরা তাদের অবস্থান, তাদের ব্যক্তিগত বিকাশকে পায় তাদের শ্রেণী দ্বারা আরোপিতভাবে, তার তলেই হয়ে পড়ে নিমজ্জিত। এটা আলাদা স্বতন্ত্রদের শ্রম বিভাগের অধীন হয়ে পড়ার মতো একই প্রপঞ্চ আর তা দূরীভূত হতে পারে কেবল ব্যক্তিসম্পত্তি ও খোদ শ্রমের অপসারণ দিয়ে। এর মধ্যেই আমরা বেশ কয়েকবার নির্দেশিত করেছি যে কি করে শ্রেণীর অধীনে স্বতন্ত্রদের ডুবে যাওয়া কেমন করে সব ধরণের ভাব ইত্যাদিরও অধীনতা ডেকে আনে।
কোন জনপদের অর্জিত উৎপাদনী শক্তি, বিশেষ করে তাদের আবিষ্কার পরবর্তী বিকাশে হারিয়ে যাবে কিনা তা নিখাদভাবে নির্ভর করে বাণিজ্যের বিস্তৃতির উপর। যতক্ষণ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীদের উপর উপচে পড়া বাণিজ্য বহাল হচ্ছে না ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি আবিষ্কার অবশ্যই প্রতিটি জনপদে আলাদাভাবে করতে হবে। বর্বরলোকদের আক্রমণ, এমনকি সাধারণ যুদ্ধের মত নিছক সম্ভাবনাগুলোও উন্নত অগ্রগামী উৎপাদনী শক্তি আর প্রয়োজনওয়ালা কোন জাতিকে আবার প্রথম থেকে শুরু করানোর জন্য যথেষ্ট। আদিম ইতিহাসে প্রতিটি আবিষ্কার প্রত্যেক লোকালয়ে নতুন করে এবং প্রতিটি লোকালয়ে স্বাধীনভাবে করতে হত। একটা ব্যাপ্ত বাণিজ্য থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনী শক্তিগুলো একেবারে ধ্বংস হওয়া থেকে যে কত কম নিরাপদ তার প্রমাণ ফিনিশিয়রা। তাদের বেশিরভাগ আবিষ্কারই হারিয়ে গেছে বাণিজ্য হতে তাদের ক্রম বিচ্ছেদ, আলেকজান্ডার কর্তৃক আগ্রাসন আর তার ক্রমাবনতির জন্য। যেমন মধ্যযুগের কাঁচে ছবি আঁকার শিল্প। কেবলমাত্র যখন বাণিজ্য হয় বিশ্ব-বাণিজ্য আর তার ভিত্তি হয় বৃহৎ শিল্প, যখন সব জাতি প্রতিদ্বন্দ্বীতার লড়াইয়ে নামে, তখনই অর্জিত উৎপাদনী শক্তির স্থায়িত্ব নিশ্চিত হয়।
বিভিন্ন শহরের মাঝে শ্রম বিভাগের প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতা হচ্ছে ম্যানুফেকচারগুলোর উত্থান, যারা হল গিয়ে উৎপাদনের সে সব শাখাগুলো যা গিল্ড পদ্ধতিকে ছাড়িয়ে গেছে। ম্যানুফেকচারগুলো প্রথম উদ্ভূত হয় ইতালি এবং পরে ফ্ল্যানডার্সে, বিদেশী জাতির সাথে বাণিজ্যিক ঐতিহাসিক ক্ষেত্রের অধীনে। অন্যান্য দেশে, যেমন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে ম্যানুফেকচার প্রথমে সংকুচিত ছিল ঘরোয়া বাজারে। পূর্বদ্ধৃত ক্ষেত্রে পাশাপাশি আরেকটা ক্ষেত্র আছে : একটি ইতঃমধ্যে অগ্রসর জনসংখ্যার ঘনীভবন (বিশেষ করে গ্রামের দিকে), আর পুঁজির ঘনীভবন (যা পুঞ্জিভূত হতে শুরু করে স্বতন্ত্রদের হাতে), অংশত গিল্ড নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও গিল্ডের মাঝেই, অংশত বণিকদের মাঝে।
শ্রম একেবারে প্রথম থেকেই, যত আকাটই হোক না কেন একটা যন্ত্রের পূর্বানুমান দেয়, আর শীঘ্রই তা নিজেকে উপস্থাপন করে সবচাইতে বিকাশ সম্ভব হিসেবে। বুনন আগে গ্রামে চাষাদের হাতে নির্বাহ হত বস্ত্রের সংস্থানের জন্য দ্বিতীয় পেশা হিসেবে; এই শ্রমটাই বাণিজ্যের বিস্তৃতির মাঝে প্রথম গতি এবং আরো বিকাশ পায়। বুননই ছিল প্রথম ম্যানুফেকচার আর রয়ে যায় অন্যতম হিসেবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে আনুসঙ্গিকভাবে বস্ত্র উপকরণের উন্নীত চাহিদা, ত্বরান্বিত সঞ্চালনের মাধ্যমে স্বাভাবিক পুঁজির ক্রমবর্ধমান পুঞ্জিভবন ও গতিময়তা,(৩৫) এই গতিময়তার ডেকে আনা বিলাসের চাহিদা যা ক্রমশ বিস্তৃতশীল বাণিজ্যের প্রশ্রয় পায়- এগুলো বুননকে পরিমাণগত ও গুণগত উদ্দীপনা দেয়। এই উদ্দীপনা অদ্যাবধি বহাল সব উৎপাদনের আঙ্গিক থেকে মোচড় দিয়ে বের করে আনে। নিজের ব্যবহারের জন্য বুনন চালিয়ে যাওয়া চাষাদের পাশাপাশি শহরে আরেক নতুন শ্রেণীর তাঁতী উঠে আসে; যাদের কাপড়ের পরিণতি ছিল পুরো বাজার আর সাধারণত বিদেশী বাজারের জন্যও। বুনন এমন একটা কাজ যা বেশির ক্ষেত্রেই কম দক্ষতা দাবী করে। সুতরাং তা শীঘ্রই অগণিত শাখায় বিভক্ত হল আর শীঘ্রই তার পুরো স্বভাব দিয়ে গিল্ডের বেড়ি বাধা দিল। তাই বুনন চলতে লাগলো প্রধানত গ্রামে আর বাজার কেন্দ্রে, গিল্ড সংগঠন ছাড়াই। ঐ জায়গাগুলো ক্রমশঃ শহর আর আসলেও প্রতিটি ভূমির সবচাইতে উদীয়মান শহর হয়ে উঠতে লাগলো। গিল্ডমুক্ত ম্যানুফেকচারের সাথে সম্পত্তি সম্পর্কও দ্রুত পাল্টে গেল। স্বাভাবিক, ভূ-সম্পত্তিগত পুঁজি(৩৬) ছাড়িয়ে প্রথম অগ্রগতি সরবরাহ করল বণিকদের উত্থান যাদের পুঁজি আরম্ভ থেকে চলমান(৩৭) ছিল, ঐ সময়ের অবস্থা মনে রেখে কেউ যতদূর ভাবতে পারে ঐ পুঁজি ছিল ততদূর আধুনিক ধারণার। দ্বিতীয় অগ্রগতিটি এলো ম্যানুফেকচারের সাথে যা আবার একগাদা স্বাভাবিক পুঁজিকে চলমান করলো, আর সব নিয়ে আরো একগাদা চলনক্ষম পুঁজিকে বৃদ্ধি করলো স্বাভাবিক পুঁজির বিরুদ্ধে। একই সময়ে, যেসব চাষাদের গিল্ড থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল অথবা কম বেতন দেয়া হত- ম্যানুফেকচার তাদের আশ্রয় শিবির হয়ে উঠলো, ঠিক যেমন করে পূর্বে গিল্ড শহরগুলো অত্যাচারী ভূমালিক অভিজাতদের হতে আসা চাষাদের আশ্রয় শিবির হিসেবে কাজ করেছে।
ম্যানুফেকচার আরম্ভ হওয়ার সমান্তরালে একটা সময় ছিল ভবঘুরেপনার। এর কারণ ছিল আঁকড়ে রাখনেওয়ালাদের সামন্ত কাঠামোর ক্ষয়, তাদের জাহাজের বিরুদ্ধে রাজাকে সেবা করতে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে ফেপে উঠা সৈন্যদের অনমনীয়তা, কৃষির উন্নতি, এবং বড়ো মাত্রার ফসলী জমির চারণ ভূমিতে রূপান্তর। কেবল এগুলো থেকেই পরিষ্কার যে, সামন্ত পদ্ধতির কাঠামো ভেঙে পড়ার সাথে এই ভবঘুরেরা কতটা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই আমরা এই ধরণের নিঃসঙ্গ কালপর্ব দেখতে পাই, তবে কেবলমাত্র পঞ্চদশের শেষ আর ষোড়শ শতাব্দীর শুরুতেই এই ভবঘুরেরা সাধারণ আর স্থায়ীরূপে আবির্ভূত হয়। তাদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরী ৭২ হাজার ভবঘুরেকে ফাঁসিতে ঝোলান। খুব কষ্টে না পড়লে, তীব্র অভাব না হলে, আর তা হলেও দীর্ঘ প্রতিরোধের পরই তারা কোন কাজে জুটতো। ম্যানুফেকচারগুলোর দ্রুত উত্থান, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, এই ভবঘুরেদের ধারণ করে। ম্যানুফেকচারওয়ালাদের অগ্রসরতার সাথে বিভিন্ন জাতিগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাশীল সম্পর্ক, ব্যবসার জন্য লড়াইযে প্রবেশ করে। এই লড়াই সারা হতো যুদ্ধ, প্রতিরক্ষাকারী শুল্ক এবং নিষেধাঞ্চার মাধ্যমে। যেখানে আগে, জাতিগুলোর মাঝে আদৌ কোন সম্পর্ক থাকলে তা সম্পন্ন হত একে অপরের অ-আক্রমণাত্মক বিনিময়ের মাধ্যমে। এখন থেকে ব্যবসার একটা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হল।
ম্যানুফেকচারের সাথে যুগপৎভাবে শ্রমিক আর নিয়োগকারীর সম্পর্ক পাল্টে গেল। গিল্ডের মধ্যে ঠিকা কারিগর আর ওস্তাদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক নিজেকে বজায় রাখে; ম্যানুফেকচারে এর জায়গা নেয় শ্রমিক আর পুঁজিপতির মাঝের আর্থিক সম্পর্ক। এটা এমন একটা সম্পর্ক যা ছোট শহরগুলো আর গ্রামাঞ্চলে একটা পিতৃতান্ত্রিক আমেজ রাখে। কিন্তু বড় শহরগুলোতে মানে আসল ম্যানুফেকচার করা শহরে অনেক আগেই পিতৃতান্ত্রিক লাবণ্য হারিয়ে যায়।
ম্যানুফেকচার এবং উৎপাদনের সঞ্চালন সাধারণভাবে বাণিজ্যের বিস্তৃতির মাধ্যমে একটা বিশাল বেগ পায়। এই বেগ এসেছিল আমেরিকা আর ইস্ট ইন্ডিজ সমুদ্র পথের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তখন নতুন উৎপাদ আমদানি হয়, বিশেষ করে গাদাগাদা সোনা ও রূপা, এগুলো সঞ্চালনে আসে আর শ্রেণীগুলোর একে অপরের প্রতি অবস্থান পুরো পাল্টে দেয়। এটি সামন্ত ভূ-সম্পত্তি আর শ্রমিকদের বড় ঝাঁকুনি দেয়; অভিযাত্রীদের অভিযান, উপনিবেশকরণ আর সর্বোপরি বাজারের বিশ্ব-বাজারে বিস্তৃতি, যা এখন সম্ভবপর আর দিন দিন বাস্তব ঘটনা হয়ে থাকে- এগুলো ঐতিহাসিক বিকাশের নতুন স্তর ডেকে আনে। এ ব্যাপারে এখানে আর বিশদ বলার অবকাশ নেই। জাতিগুলোর একে অপরের সাথে বাণিজ্যিক লড়াই নতুন আবিষ্কৃত দেশগুলোতে উপনিবেশিকরণের মাধ্যমে নতুন ইন্ধন পায়, পায় আরো বেশি বিস্তৃতি আর বিদ্বেষ।
বাণিজ্য আর ম্যানুফেকচারের বিস্তার চলনক্ষম পুঁজির পুঞ্জিভবনকে ত্বরান্বিত করে, যখন গিল্ডগুলোতে (যেগুলো তাদের উৎপাদন বিস্তৃত করার মতো উদ্দীপ্ত ছিল না) স্বাভাবিক পুঁজি রয়ে যায় থিতু, এমনকি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে। বাণিজ্য আর ম্যানুফেকচার বড়ো বুর্জোয়া তৈরী করলো : গিল্ডে পেটি বুর্জোয়ারা একা-া হয়েছিল, যারা শহরে আগের মত দাপট নিয়ে ছিল না, বরং বড় ব্যবসায়ী আর ম্যানুফেকচার করণেওয়ালার শক্তির সামনে মাথা ঝোঁকাতো। যখনি গিল্ডগুলো ম্যানুফেকচারের ছোঁয়ার নাগালে এলো তখনি তার ক্ষয় ঘটলো।
যে কালপর্বের কথা আমরা বলছি, সেখানে জাতিগুলোর বস্তুগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক দুটো আলাদা আঙ্গিক নিল। প্রথমে সোনা আর রূপার এই অল্প পরিমাণের সঞ্চালন এই সব ধাতুর আমদানিতে নিষেধাঞ্চা আনলো। আর শিল্প (যার বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা আর বর্ধিষ্ণু শহুরে জনগণের কাজ দেবার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো) শুধু ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রধানত বিদেশী শিল্পের বিরুদ্ধে আনা সুবিধাগুলো ছাড়া অচল ছিল। এই সব নিষেধাঞ্চার মাঝে স্থানীয় গিল্ড, বিশেষ ছাড় জাতিতে বিস্তৃত ছিল। সামন্ত প্রভুদের এলাকা দিয়ে পার হওয়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা উপঢৌকন পদ্ধতি শহরেও চালু হয়, আর তা আধুনিক রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে রাজস্ব অর্থ আদায়ের প্রকৃষ্ট উপায় হয়ে উঠে। য়ুরোপীয় বাজারে আমেরিকান সোনা রূপার আবির্ভাব, শিল্পের ক্রমবর্ধমান বিকাশ, ব্যবসার তুমুল বিস্তার এবং অ-গিল্ড বুর্জোয়া আর টাকার তৎসঙ্গের বৃদ্ধি এই মাপকাঠিগুলোকে আরেকটা বৈশিষ্ট্য দিল।
রাষ্ট্র টাকা ছাড়া চলতে প্রতিনিয়ত অক্ষম থেকে অক্ষমতর হয়ে যাচ্ছিল; এখন সে রাজস্ব বিবেচনায় সোনা রূপার রফতানী নিষিদ্ধ করে। বুর্জোয়ারা (যাদের প্রধান ধ্যানঞ্চানের বিষয় ছিল এই গাদাগাদা টাকাগুলোকে কোণঠাসা করা, যে টাকাগুলো উথাল পাথাল করে বাজারে ঢুকে পড়েছিল) এবার সম্পূর্ণ তৃপ্ত হল। পূর্বে স্থাপন করা বিশেষ সুবিধাগুলো সরকারের জন্য অর্থের উৎস হল আর টাকার বিনিময়ে বিক্রি হতে লাগলো। শুল্ক আইন কানুনে আবির্ভূত রফতানী কর শিল্পের পথে একটা শুধুমাত্র বিপত্তি তৈরী করলেও এর উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ রাজস্ব সংক্রান্ত।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় সতেরো শতকের মাঝ থেকে, চলে আঠারোর প্রায় শেষ পর্যন্ত। বাণিজ্য আর নৌ বিদ্যা ম্যানুফেকচারের থেকে দ্রুত বিকশিত হতে থাকে, যা দ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে। উপনিবেশগুলো বেশ ভালো ভোক্তা হয়ে উঠছিল; আর দীর্ঘ সংঘাতের পর আলাদা জাতিগুলো উন্মুক্ত হতে থাকা বিশ্ব-বাজার নিজেদের মাঝে ভাগ করে নেয়। এই পর্যায় শুরু হয় নৌ বিদ্যা আইন আর ঔপনিবেশিক একচেটিয়াপনা দিয়ে। জাতিগুলোর নিজেদের মাঝের প্রতিযোগিতা যদ্দুর সম্ভব নির্ধারিত শুল্ক, নিষেধাঞ্চা আর চুক্তির মাধ্যমে বাদ দেয়া হল। তাতেও না কুলোলে পর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লড়াই চলতো আর নিস্পত্তি হত যুদ্ধে (বিশেষ করে নৌ যুদ্ধে)। সবচাইতে শক্তিধর নৌ শক্তিওয়ালা জাতি ইংরেজরা ব্যবসা আর ম্যানুফেকচারে পূর্ব ওজন বজায় রাখে। ইতঃমধ্যেই এখানে আমরা দেখি একটা দেশের কেন্দ্রীকরণ। সব সময়ই ম্যানুফেকচার ঘরোয়া বাজারে সংরক্ষণ করের আশ্রয়ে, উপনিবেশের বাজারে একচেটিয়াপনার, আর বিদেশে যদ্দুর সম্ভব অন্তরফলিত করের আশ্রয়ে থাকতো। ঘরে উৎপাদিত দ্রব্যের কাজ কারবার উৎসাহিত হল (ইংল্যান্ডে উল আর লিনেন, ফ্রান্সে সিল্ক), ঘরে উৎপাদিত কাঁচা মাল রফতানী নিষিদ্ধ (ইংল্যান্ডে উল) আর আমদানি করা মাল অবহেলা বা চাপের শিকার হলো (ইংল্যান্ডে তুলা)। যে জাতি নৌ বাণিজ্য আর ঔপনিবেশিক শক্তিতে দাপট নিয়ে চলতো স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজেদের জন্য ম্যানুফেকচারের বৃহত্তম পরিমাণগত এবং গুণগত বিস্তৃতিও নিশ্চিত করলো। সংরক্ষণ ছাড়া ম্যানুফেকচার নির্বাহ করা সম্ভব হত না- যেহেতু অন্য দেশে সূক্ষ্মতম পরিবর্তন হলেও তাকে তার বাজার হারিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ভয় থাকতো। যৌক্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য শর্তে একে অন্য দেশে সহজেই ঢোকানো যেত, কিন্তু একই কারণ দিয়ে একে ধ্বংসও করা যেত। একই সময়ে একে নির্বাহের ধরণের মাঝ দিয়ে, বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রামাঞ্চলে, একটি বিশাল সংখ্যার স্বতন্ত্রের প্রাণবন্ত সম্পর্কের সাথে এমন হরিহরাত্মা হয়ে ছিল যে কোনই গ্রামই মুক্ত প্রতিযোগিতার অনুমতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিনাশের দুঃসাহস করতো না। আর যদ্দুর পর্যন্ত এটা রফতানীর ব্যবস্থা করতো, এটা তাই পুরোপুরি নির্ভর ছিল বাণিজ্যের বিস্তৃতি বা নিষেধাঞ্চার ওপর, আর নিষেধাঞ্চার ওপর খুব নগণ্য প্রতিক্রিয়াই দেখাতো। এভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বহাল হল এর গুরুত্বের গৌণতা আর বণিকদের প্রভাব। বিশেষ করে বণিক আর জাহাজীরাই রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা আর একচেটিয়াপনার জন্য বেশি চাপ দেয়। ম্যানুফেকচারওয়ালারাও দাবি তুলে সত্যিই নিরাপত্তা পেয়েছিল, তবে সবসময়ই তারা বণিকদের চাইতে কম রাজনৈতিক গুরুত্বের ছিল। ব্যবসায়ী, বিশেষ করে সমুদ্র ধারে শহরগুলো একটা মাত্রা পর্যন্ত বড় বুর্জোয়াদের সভ্য দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিল। কিন্তু কারখানা শহরগুলোতে চূড়ান্ত পেটি বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি বজায় ছিল। (দেখুন আয়কিন, অন্যান্য।) অষ্টাদশ শতাব্দী ছিল বাণিজ্যের শতাব্দী। পিন্টো চমৎকার বলেন : বাণিজ্য হচ্ছে শতাব্দীর উন্মাদনা, আজকাল লোকজন শুধু বাণিজ্য, নৌ বিদ্যা আর নৌ বাহিনীর কথা বলছে।*
এই কালের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে- যেমন সোনা রূপা রফতানীর নিষেধাঞ্চা প্রত্যাহার আর বড়ো মাপে সোনা রূপা বাণিজ্য আরম্ভ হওয়া, ব্যাংক, জাতীয় দায়, কাগুজে মুদ্রা প্রচলন, স্টক আর শেয়ারে অনুমান করে লগ্নি, আর সব আইটেমে স্টক জবিং, লগ্নিতে সাধারণ বিকাশে পুঁজি আবার তার সাথে ঝুলে থাকা বিশাল পরিমাণ স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারালো। একটি দেশ- ইংল্যান্ডে, ব্যবসা আর ম্যানুফেকচার ঘন হয়ে আসে। সপ্তদশ শতাব্দীতে তা অপ্রতিরোধ্যভাবে বিকশিত হয়, দেশটার জন্য একটা আপেক্ষিক বিশ্ব-বাজার তৈরী করে। এভাবে তাদের ম্যানুফেকচার করা উৎপন্নের এমন চাহিদা সৃষ্টি হল যা আর এখন পর্যন্ত বহাল উৎপাদনী শক্তি দিয়ে পূরণ করা গেল না। উৎপাদনী শক্তি ছাপিয়ে যাওয়া এই চাহিদার প্রণোদনা শক্তি, (বৃহৎ শিল্প উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাথমিক উপাদানগুলোকে শিল্প লক্ষ্যে প্রয়োগ, যন্ত্রপাতি আর সবচাইতে জটিল শ্রম বিভাগ) মধ্যযুগ হতে থাকা এই নতুন স্তরের অন্যান্য পূর্ব শর্ত আগে থেকেই বহাল ছিল : জাতির ভেতর প্রতিযোগিতার স্বাধীনতা, বলবিদ্যার তাত্ত্বিক বিকাশ ইত্যাদি। নিউটনের নিখুঁত করা বলবিদ্যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে আসলেও সব মিলিয়ে ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে সবচাইতে জনপ্রিয় বিঞ্চান ছিল। (দেশের ভেতরে খোদ মুক্ত প্রতিযোগিতা বিপ্লবের মাধ্যমে জিতে নিতে হয়েছে- ১৬৪০ ও ১৬৮৮ ইংল্যান্ডে, ১৭৮৯ ফ্রান্সে)। যে দেশগুলো তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা অব্যাহত রাখতে চাইলো, প্রতিযোগিতা শীঘ্রই তাদের বাধ্য করলো নবায়িত শুল্ক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তার ম্যানুফেকচারগুলো রক্ষা করতে (বড় শিল্পের বিরুদ্ধে পুরনো কর আর কাজের ছিল না) আর তার পরেই প্রতিরক্ষাশীল করের অধীনে বড় শিল্প শুরু করতে।
এসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ সত্ত্বেও বৃহৎ শিল্প প্রতিযোগিতা সার্বিকীকরণ করলো (এটা ব্যবহারিক মুক্ত বাণিজ্য; শুল্ক শুধু মুক্ত বাণিজ্যের ভেতরে ক্ষণিক স্বস্তি, প্রতিবন্ধকতা), যোগাযোগের উপায় আর আধুনিক বিশ্ব বাজার প্রতিষ্ঠা করলো, বাণিজ্যকে এর নিজেরই অধীন করলো, সব পুঁজিকে শিল্প পুঁজিতে রূপান্তরিত করলো আর এভাবে ত্বরিত সঞ্চালন (আর্থিক ব্যবস্থা নিখুঁত হল) আর বিভিন্ন আঙ্গিকের পুঁজির কেন্দ্রীভবন উৎপাদন করলো। সার্বিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তা সব স্বতন্ত্রকে তাদের উদ্যমের সর্বোচ্চ খাটুনিতে বাধ্য করে। যদ্দুর সম্ভব ভাবাদর্শ, ধর্ম, নৈতিকতা ধ্বংস করলো, যেখানে পারলো না সেখানে ওগুলোকে ডাহা মিথ্যে বানিয়ে দিলো। প্রতিটি সভ্য দেশ আর তার প্রত্যেক স্বতন্ত্র সদস্যকে অভাব পরিতৃপ্ত করতে সে তাদের পুরো পৃথিবীর উপর নির্ভরশীল করলো। এভাবে ধ্বংস করলো আলাদা জাতিগুলোর পূর্বতন স্বাভাবিক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই কাজগুলোর মাত্রায় সে প্রথমবারের মত বিশ্ব-ইতিহাস উৎপাদন করলো। প্রকৃতি বিঞ্চানকে এটা পুঁজি সেবাদাস করলো আর শ্রম বিভাগের প্রাকৃতিক চরিত্রের শেষ ছোঁয়াটুকুও সরিয়ে নিয়ে শ্রম বহাল রেখে যদ্দুর সম্ভব সে স্বাভাবিক বৃদ্ধি সাধারণভাবে রদ্‌ করে সব স্বাভাবিক সম্পর্ককে অর্থ সম্পর্কে পাল্টে ফেলে। স্বাভাবিক শহরের বদলে তৈরী হয় রাতারাতি মাটি ফুঁড়ে ওঠা বিশাল আধুনিক শিল্প, যা পূর্বতন দশা ধ্বংস করে। এর প্রথম প্রাকসিদ্ধান্ত ছিলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। এর বিকাশ একগাদা উৎপাদনী শক্তির উৎপাদন করলো, যার জন্য ব্যক্তি মালিকানা ততটাই লাগসই হয়ে গেল গিল্ড যেমন ছিল ম্যানুফেকচার আর ছোট গ্রাম্য কারখানা যেমন ছিল বিকাশমান ঘরোয়া শিল্পের জন্য। ব্যক্তিসম্পত্তির অধীনে এই উৎপাদনী শক্তি কেবল একপেশে বিকাশ পায় আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে উঠে বিধ্বংসী শক্তি। তদুপরি, এ ধরণের বিশাল এক শক্তি এই ব্যবস্থার মাঝে আদৌ কোন প্রয়োগ খুঁজে পায় না। সাধারণভাবে বলতে গেলে, এটা সব জায়গায় সমাজের শ্রেণীগুলোর মাঝে একই সম্পর্ক তৈরী করে আর এভাবে বিভিন্ন জাতিসত্তার বৈশিষ্টপূর্ণ স্বতন্ত্রতা ধ্বংস করে। আর চূড়ান্ত বিচারে, প্রত্যেক জাতির বড় বুর্জোয়ারা যেখানে এখনো আলাদা জাতীয় স্বার্থ আঁকড়ে ছিলো, সেখানে বড় শিল্প এমন এক শ্রেণী তৈরী করলো যার সব জাতির মাঝে একই স্বার্থ আর যার সাথে জাতীয়তা ইতঃমধ্যেই মারা পড়েছে। এটি এমন একটি শ্রেণী যা বাস্তবিক পুরনো বিশ্বকে গা ঝাড়া দিয়ে ফেলেছে এবং একই সময়ে তার জন্য কোন মায়া মমতাও দেখায়নি। আর শ্রমিকদের জন্য শুধু পুঁজিপতিদের সাথে সম্পর্কটাই না খোদ শ্রমকেই অসহ্য করে তোলে।
একটা দেশের সবগুলো জেলাতে বৃহৎ শিল্প যে সমান বিকাশ অর্জন করে না তা প্রমাণিত। যা হোক, তা প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রাম মন্থর করে না। কারণ বৃহৎ শিল্পের সৃষ্ট প্রলেতারিয়েত এই আন্দোলনের নেতৃত্বের পূর্বসিদ্ধি দেয় আর তাদের সাথে পুরো জনসংখ্যাটাকেই সাথে নিয়ে চলে। আরো কারণ হচ্ছে বৃহৎ শিল্প থেকে আলাদা হওয়া শ্রমিক বৃহৎ শিল্পের শ্রমিকদের চাইতে আরো খারাপ অবস্থায় পড়ে। যদ্দুর পর্যন্ত শিল্পে অবিকশিত দেশগুলো সার্বিক বাণিজ্য দ্বারা সার্বিক প্রতিযোগিতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ততদুর পর্যন্ত বৃহৎ শিল্প বিকশিত দেশগুলোর ক্রিয়ার সাথে কম বা বেশি অ-শিল্প দেশগুলোর বিশেষ তফাৎ থাকে না।* এই বিভিন্ন আঙ্গিকগুলো নেহাত শ্রম সংগঠনের অনেকগুলো আঙ্গিক আর এভাবে সম্পত্তির অনেকগুলো আঙ্গিকও বটে। প্রতিকালে বহাল উৎপাদনী শক্তির একত্রিকরণ সংগঠিত হয়, যদ্দুর পর্যন্ত এটা প্রয়োজন কর্তৃক তাড়িত।

পরবর্তী অংশ