Marxists Internet Archive
Bangla Section


জার্মান ভাবাদর্শ

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

পাঠ প্রস্তাবনা

১.
ক. মরমের দর্শন

রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইয়াছে
সোনার ময়না ঘরে থুইয়া বাইরে তালা লাগাইছে
- জালাল উদ্দিন খাঁ
আচার্য কার্ল মার্ক্সের বেড়ে ওঠার কালে; মানে ১৮৩০ দিকে, এখন যাকে জার্মানী বলি তার সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একপেশে রকম চালু ছিল হেগেলের দর্শন। মার্ক্সের নিজের মতেই তিনি যাকে পরে সার্কাস করা থেকে বাঁচিয়ে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। আচার্য যে জমিনের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর মতামতগুলো দিয়েছেন, সেগুলো অষ্টাদশ শতাব্দীতেই একটা পদ্ধতি হিসেবে দাঁড়ায়। তার আগে য়ুরোপীয় ধ্রুপদী কালে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বেশ অনেকগুলো বিশ্বাস আর আপ্ত বাক্যের তৈরী করা আর বিদ্রোহ চলছিল। ঐ বিদ্রোহগুলোকে কেতাবী ভাষায় জ্ঞএনলাইটেনমেন্টঞ্চ বলে ডাকা হয়।
এর আগ পর্যন্ত সোজা চোখে মানুষের কাজকারবার জমি আর তার সাথে জুড়ে থাকা মানুষের ক্রিয়াকলাপ বলে চেনা যেত। পুঁজিবাদের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসে প্রথমবারের মত মানুষ তার কাজ কারবারের সংঞ্চাটা পাল্টে ফেললো। তার নিজের শ্রমের উৎপন্নঞ্চর সাথে সম্পর্ক জটিল হলো। তার বহুরকম চেহারা, বহুরকম সাজসজ্জা। শ্রম, উৎপন্ন আর ভোগদখলের চেহারা প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়াতে স্কলাস্টিক দর্শন বিমুখ য়ুরোপের দর্শন বিকল্প ঈশ্বর খুঁজে বের করলো। গ্যালিলিও মহাবিশ্বের কেন্দ্র হতে মানুষকে ছিটকে বের করে দিলেও তার জায়গায় রয়ে গেল মানুষের বুদ্ধি। কথাটা সোজা- ঐ সত্যটা তো মানুষ বুদ্ধি দিয়েই জেনেছে। উৎপাদনের ফলে পাওয়া উৎপন্ন যখন থেকে পণ্য হল, তখন থেকে প্রকৃতির সাথে মানুষের মেলামেশার সম্পর্ক প্রচ্ছন্ন হয়ে খোদ মানুষের বদলে মানুষের বুদ্ধিকে প্রধান করে দেখা শুরু করলো। দীর্ঘ দিনের এই বন্দী দশা কাটিয়ে হঠাৎ করে আংশিক মুক্তি পাওয়া জ্ঞবুদ্ধিঞ্চ নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা শুরু করলো। ব্যবসা আর মুনাফা যেমন করে নিজের জন্মের দায় মানুষের শ্রমের কাছে স্বীকার করে না, তেমনি করে বুদ্ধিবাদও মানুষের ইতিহাস অভিঞ্চতার কোন পরোয়া না করেই ঞ্চান লাভ সম্ভব বলে মনে করে। কারণ পুঁজিবাদেরই বৌদ্ধিক রূপ হল বুদ্ধিবাদ বা র‌্যাশনালিজম। শুধুমাত্র বুদ্ধি প্রয়োগ করেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করা এর লক্ষণ। এর অধীনে মানুষের আকাঙ্খা, কল্পনা আর স্বপ্নের এক বিশাল ভান্ডার জমা হয়েছিল। তার প্রয়োগ, পর্যালোচনা থেকেই তার গোমর ভেঙে যায়। এখন কেতাবী ভাষায় যাকে বলে বুদ্ধিবাদ, সেই বুদ্ধিবাদের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তার দৌড় আরো বেশি। ইংল্যান্ডে জন লক, ডেভিড হিউম বুদ্ধিবাদের কড়া বিরোধিতা করেন। তাদের বিরোধিতা আসলে পুঁজিবাদের প্রথম ফর্মাল সাংগঠনিক ছককে সময়োপযোগী করার প্রয়াস ছিল। পুঁজিবাদের সবচাইতে প্রাগ্রসর অভিঞ্চতা এই অভিঞ্চতাবাদীদের কাজে লেগেছিল। ফর্মাল বুদ্ধিবাদের সবচাইতে বড় দার্শনিক মুরব্বী ছিলেন রেনে দেকার্ত আর লাইবনিৎজ। এঁরা মানুষের ঞ্চান লাভের পথ হিসেবে একক বুদ্ধির প্রয়োগে এমন আস্থাশীল ছিলেন যে, তারা একটা গাণিতিক ভাষা তৈরীর কথা ভাবেন, এমনকি কিছুদূর হাতে কলমেও এগোন। তারা ভেবেছিলেন, ঞ্চান চর্চার মূল ভিত ভাবনার ইঁটগুলো যে ভাষার পদ দিয়ে তৈরী তাকে যদি সুসংবদ্ধ করে ফেলা যায়, তাহলে ঞ্চান অর্জন বা যাচাইয়ের খামাখা কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আজকের সময়ে তথ্য প্রযুক্তির দর্শনও একই কথা বলে বেড়াচ্ছে। এসব কথা বুদ্ধিবাদ বা পুঁজির গা জোয়ারী। সে ভাবে যে- তার পরে আর কিছু নেই।
যা হোক, বুদ্ধিবাদের এই আঁটসাঁট ধরণ প্রথম আক্রান্ত হয় ইংল্যান্ডে। সেখানে লক, হিউম; পরে জেরেমি বেনথাম জিনিসের বাস্তব প্রকৃতির মধ্যে বৌদ্ধিক সত্তার মত কোন কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তারা বলেন, যেহেতু কেবলমাত্র সংবেদন দিয়েই সব তথ্য বাহিত হয়, সুতরাং বুদ্ধি ঞ্চানের স্বাধীন উৎস হতে পারে না। বড় জোর তা দিয়ে প্রাপ্ত তথ্য সাজিয়ে গুছিয়ে, বাদ-ছাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে এই বুদ্ধিবাদ আক্রমণের স্বীকার হয় বস্তুবাদী ঘরানার হাতে। (এখানে একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, মার্ক্সের পরে আমরা আজকে যেমন করে বুঝি যে, নিরেট বস্তুবাদী বা ভাববাদী দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কিছু নেই; ঐ সময়ে ব্যাপারটা অমন ছিল না। সে স্পেশালাইজেশন অনেক পরের কথা।) ওখানে ভলতেয়ার, দিদেরো, কঁদিলাক, হেলভেশিয়াসঞ্চরা খোলাখুলিভাবে ইংরেজ মুক্তচিন্তাবিদদের ঋণ স্বীকার করে একদম আলাদা এক ঘরানা তৈরী করেন। দার্শনিক পরিভাষাগুলোকে কেতাব থেকে নামিয়ে এই ধুলোবালির জগতে দৌড় করানোর বড় কৃতিত্ব তাদের। সন্দেহবাদী মঁতেইন তার জন্য অনেক আগে থেকেই জমি তৈরী করা শুরু করেছিলেন। এই ঘরানার বড় একটা অভ্যাস ছিল কর্তৃত্বের বিরোধিতা করা। জন লক বলেছিলেন, মানুষের বুদ্ধি স্বাধীন কিনা, তার আগের প্রশ্ন খোদ মানুষ স্বাধীন কিনা? তাঁর দেয়া আভাসকে স্পষ্ট করে ভাবতে বাধ্য করলো ফরাসি ঘরানা।
ফরাসি দেশে কর্তৃপক্ষের দিকে ভরসার অভাবেরও কারণ আছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতি, ঐ দেশের তুলনায় তাদের ধীরগতির অর্থনৈতিক বিকাশ, তথাকথিত কোন যোগ্য নেতৃত্বকারী শ্রেণী প্রতিনিধি না থাকা এর পেছনে খুব কাজ করেছে। প্রশ্নহীন বৌদ্ধিক সংঞ্চার মত যাজক বা ঈশ্বরতন্ত্রকেও তারা সমানভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, বুদ্ধি অনেক অন্যায়কেও ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। যেমন, এরিস্টটল বুদ্ধির বরাত দিয়েই মানুষের মাঝে দাস আর স্বাধীন মানুষের অসাম্যকে প্রাকৃতিক বলে চালিয়ে দিয়েছেন। তেমনি বাইবেলও বলছে যে, মানুষ তার আদি উৎস হতেই স্বভাবগতভাবে পাপী। এই সব বক্তব্য রাষ্ট্রে বা সমাজ সংগঠনে কিছূ মানুষের সুখ ভোগ আর বাকিদের কলুর বলদ হবার পক্ষে যুক্তি দেয়। অন্যায়কে বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিক বলে সিদ্ধ করতে চায়। কিন্তু বুদ্ধি আর অভিঞ্চতাকে ঠিকমতো বুঝে মিল খাওয়াতে পারলে পুরো উল্টো সাক্ষী পাওয়া যায়। সম্ভাব্য কোন সন্দেহ ছাড়াই যুক্তি দাঁড় করানো যায় যে, মানুষ স্বভাবতই ভালো, সব মানুষেরই সমান বুদ্ধি আর সব দূর্দশা আর শোষণের কারণ হচ্ছে মানুষের অঞ্চতা। এই অঞ্চতার কারণ অংশত স্বাভাবিক ঐতিহাসিক বিকাশের পথে উঠে আসা সামাজিক ও বস্তুগত অবস্থা, আর অংশত স্বার্থান্বেষী স্বৈরাচার আর যাজকদের হাত দিয়ে সত্যকে ইচ্ছে করে লুকিয়ে বা দাবিয়ে রাখা। কোন আলোকায়িত, পরস্বার্থব্রতী সরকারের কাজকর্ম দিয়ে তাহলে এই মন্দ প্রভাব কাটিয়ে ওঠা যায়। তাহলে মানুষের বুদ্ধি চর্চায় কর্তৃপক্ষ আর বিশেষ সুবিধার জায়গায় আসবে ন্যায়বিচার আর সাম্য; প্রতিযোগিতার জায়গায় সহযোগিতা।
এই আধা-অভিঞ্চতাবাদী বুদ্ধিবাদের কেন্দ্রীয় একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। তা হল- জগতকে ব্যাখ্যা আর উন্নতি করায় বুদ্ধির প্রতি অগাধ বিশ্বাস। কারণ, মানব দূর্দশা হচ্ছে অঞ্চতার এক জটিল ফলাফল, শুধু প্রকৃতির নয়, মানব সমাজের নিয়মেরও। একে নির্মূল করতে হলে মানব কাজকর্মে শুধুমাত্র বুদ্ধির প্রয়োগই যথেষ্ট। কাজটা সহজ নয়; কারণ মানুষ এত সুদীর্ঘকাল বৌদ্ধিক অন্ধকারের পৃথিবীতে কাটিয়েছে। সুতরাং এক ঝাঁক আলোকায়িত, জীবন ব্রতী মানুষ দরকার, যারা যুক্তিবুদ্ধির প্রয়োগ আর সত্যের অগ্রসরতার জন্য পথভ্রষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে কাজ করে যাবে।
ঠিক এখানেই নতুন একটা সমস্যা দেখা দেয়। যদি মানুষের দূর্দশার কারণ হয় যুক্তি, বুদ্ধির প্রতি অবঞ্চা, তাহলে এটাও কি সত্য না যে, এক শ্রেণীর মানুষ স্বেচ্ছায় এই অঞ্চতাকে জিইয়ে রেখেছে? তাদের ক্ষমতার উৎসও কি এই অঞ্চতা নয়? তাদের ক্ষমতা বহাল থাকাতেই মানুষ আজো অন্যায়, অসাম্য চিনে উঠতে পারেনি, একি সত্য না? প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষই বৌদ্ধিক, যৌক্তিক। আর সব যৌক্তিক, বৌদ্ধিক প্রাণীরই বুদ্ধির প্রাকৃতিক নিয়মের অনুযায়ী সমান অধিকার। কিন্তু শাসক শ্রেণী, রাজা, অভিজাত, পুরুত মানুষকে চার্চের পবিত্রতা, রাজার ঐশ্বরিক অধিকার, জাতীয় গৌরব, এসব ধান্ধাবাজীর নামে বেগার খাটাচ্ছে। তারা আবেগহীন ভাবে নিজের পরিশ্রমে ছোট একটা শ্রেণীকে বিলাস, আরাম আয়েশে টিকিয়ে রাখছে। মানুষ বুদ্ধি দিয়ে চোখ খুললেই তা আর হবার নয়। সুতরাং কোন আলোকায়িত শাসকের প্রথম কাজ ঐ সুবিধাপ্রাপ্ত ধান্দাবাজ শ্রেণীর ক্ষমতা লোপ করা। তারপরও কিছু গন্ডগোল থেকে যাবে; তবে যেহেতু যৌক্তিকতা কখনো যৌক্তিকতার বিপরীতে যেতে পারে না, তাই সমাজের ক্ষুদ্র, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সংঘাত অযৌক্তিক বলে বাদ পড়ে যেতে বাধ্য। সব মিলিয়ে মানুষ আসবে স্বাভাবিক বুদ্ধি, যৌক্তিকতার অধীনে। বুদ্ধি সর্বদাই সঠিক। প্রতিটি প্রশ্নের একটি মাত্র সঠিক উত্তর আছে, যা বুদ্ধি দিয়ে উদ্‌ঘাটন করা যায়। একবার তা বের করে ফেলতে পারলে তখন তাকে নৈতিকতা, রাজনীতি, ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে; তারপর পদার্থবিদ্যা বা গণিতের সমস্যায় সমানভাবে প্রয়োগ করা যাবে। শুধুমাত্র তা একবার সমাধিত হয়ে গেলেই হয়; তবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা প্রগতির শত্রুকে আগে অপসারিত করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার তুলনায় পরিবেশের প্রভাবও কম নয়। মানুষ প্রকৃতির মাঝেই একটি বিষয়। মানুষের জীবনের সব কিছুকেই সাধারণ প্রাকৃতিক, পদার্থগত হাইপোথিসিস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছুর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। ফরাসি দার্শনিক লা মেত্রি তাঁর কঞ্চএষলন খতদবভশন প্রবন্ধে এই মতের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। ফরাসি বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর দিদেরো, দ্যলম্বার্ত, হলবাখ্‌, হেলভেশিয়াস, কঁদিলা মোটামুটিভাবে এই মতই মানতেন। তবে একটা ব্যাপারে সবাই তারা সমানভাবে একমত : মানুষ অন্যসব জীব থেকে আত্ম-চৈতন্যতা থেকেই ভিন্ন হয়। এই পার্থক্য সূচিত হয় তার বুদ্ধি আর কল্পনার প্রয়োগ দিয়ে, আদর্শ উদ্দেশ্য ঠিক করতে পারা দিয়ে, তার বুঝতে চাওয়া বিষয়ে নৈতিক মূল্যবোধ সন্নিবিষ্ট করাতে। এখানে একটা বড় সমস্যা দেখা দিল। সমস্যাটা হল মুক্ত ইচ্ছা আর বিভিন্ন শর্ত এবং পরিবেশের সম্পূর্ণ নির্ধারণের মাঝখানে বোঝাপড়া করা। পুরোনো কালের সেই মুক্ত ইচ্ছা এবং দৈব পরিকল্পনারই নতুন এক আঙ্গিক দেখা গেল; শুধু ঈশ্বরের জায়গায় এল প্রকৃতি। স্পিনোজা তারও আগে বলেছিলেন, একটা পড়ন্ত পাথর তার পতনের বাহ্যিক কারণগুলো না জানলে ভাবতেই পারে যে, সে তার গতিপথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। ঠিক তেমনটাই ঘটবে মানুষের ক্ষেত্রে, যদি সে তার আচরণ, সংগঠনের কারণগুলো না জানে। এমনি হলে মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকান্ডই তো প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই ঘটে। যা ঘটেছে, তা পূর্বের; আর যা ঘটবে, তা বর্তমানের প্রক্রিয়ার ফল। স্বতন্ত্রের মুক্ত ইচ্ছা যতই ভালো হোক, তা ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না। অনেক পুরোনো ধর্মতাত্ত্বিক এই ধাঁধা ইহজাগতিক আঙ্গিকে আরো ধারালো হল। য়ুরোপীয় দর্শন জগত দুঞ্চশিবিরে ভাগ হয়ে পড়লো। একদিকে নাস্তিক, সন্দেহবাদী, ব্রহ্মবাদী, বস্তুবাদী, বুদ্ধিবাদী, গণতন্ত্রী, উপযোগবাদী; আর অপরদিকে ধর্মওয়ালা, অধিবিদ্যাবাদী, বহাল ব্যবস্থার সমর্থক আর সাফাই গানেওয়ালা। আলোকায়ন আর কেরানীতন্ত্রের মাঝে ফাটল এত ব্যাপক আর লড়াই এত তীব্র হল যে, প্রত্যেক শিবিরের ভেতরকার পার্থক্যগুলো একরকম অপরিলক্ষিত রইলো।
দুই শিবিরের মাঝে প্রথমটিই পরবর্তী শতাব্দীর র‌্যাডিকেল বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রীয় মত হয়ে রইলো। তারা মানুষের মাঝে শত দুরবস্থাতেও বিদ্যমান শুভত্বের প্রচার করতে লাগলো। বলতে রইলো যৌক্তিক শিক্ষা আর বর্তমান দূরবস্থা হতে মানুষকে উদ্ধার করে ন্যায়সঙ্গত সমাজে জাগতিক সম্পদের বৈঞ্চানিক বন্টনের কথা। আরো মনে রাখতে হবে যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর বৌদ্ধিক জগত গত শতাব্দীর গাণিতিক ও পদার্থবিদ্যার ব্যাপক অগ্রসরতা দিয়ে প্রভাবিত ছিল (কেপলার, গ্যালিলিও, দেকার্ত, নিউটন)। ফলে ওই রকম নিখুঁত প্রণালী সমাজের ক্ষেত্রেও খোঁজ হতে লাগলো। ভলতেয়ার হয়ে উঠলেন মানব ধর্মের অবিসংবাদিত আদি পুরুষ। চরম শ্লেষ আর হাসির হুল্লোড় দিয়ে কিংবদন্তীর বীরের মত তিনি লড়লেন ক্যাথোলিকবাদ আর কেন্দ্রগত শাসনের বিরুদ্ধে। জীবিতকালে তাঁর সাথে জাঁ জাঁক রুশোর প্রচন্ড রেষারেষি ছিল। তবে এও সত্য, ভলতেয়ার যদি হন মানব ধর্মের স্রষ্টা তাহলে রুশোই তার সবচেয়ে বড় প্রেরিত পুরুষ। মানুষ সম্পর্কে তার মত ঐ কালের র‌্যাডিকেলদের চাইতে একদম অন্যরকম ছিল। বলা যায়, তিনি বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণের বিনিময়ে মানব ইচ্ছাকে মহিমান্বিত করেছিলেন। সমস্ত মানবিক প্রতিষ্ঠান তার কাছে ছিল মানুষের নিজেদের সুবিধার জন্য করা স্বেচ্ছা সামাজিক চুক্তি। তার মনে হয়েছিল- এই সভ্যতাই মানুষের দূর্দশার মূল। ব্যক্তি সম্পত্তির ধারণাহীন, প্রকৃতির মাঝে সুখে বাস করা মানুষদের মাঝে যে বদমাশ প্রথম লাঠি গেড়ে বললো- এ জমি আমার, সেই প্রথম সভ্য মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের বাংলা বৌদ্ধিক চর্চাঞ্চর অন্যতম পুরুত বঙ্কিমচন্দ্রেরও মনে হয়েছিল- রুশোর জ্ঞসামাজিক চুক্তিঞ্চ বইটিতে ফরাসি বিপ্লবের যঞ্চে আহুতি মন্ত্র ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প মানস এবং সমাজ বিদ্রোহীরা নিজেদের প্রকাশের জন্য তার কাছে অনেকাংশে ঋণী। রোমান্টিকদের প্রথম প্রজন্ম ফ্রান্সের বিপ্লবী ইতিহাস আর লেখাপত্রের মাঝেই অনুপ্রেরণা খুঁজতেন। এদের মাঝে ইংল্যান্ডের ওয়েলশ ম্যানুফেকচারার রবার্ট ওয়েন ছিলেন সবচাইতে একাগ্র আর প্রভাবশালী। তাঁর জার্নালের শিরোনামের ওপরে খোদিত ছিল জ্ঞজ্ঞনতুন নৈতিক জগতঞ্চঞ্চ। নিউ ল্যানার্কে তাঁর নিজের কাপড়ের কলে তিনি আদর্শ অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কর্ম ঘন্টা কমিয়ে, স্বাস্থ্য ও সঞ্চয় খাত খুলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিগত ওয়েন ছিলেন বুদ্ধিবাদের ধ্রুপদী যুগের শেষ প্রতিনিধি।
এই সব ভাবনার য়ুরোপীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব ইতালিয় রেঁনেসার চাইতে কম ছিল না। ব্যক্তি এবং সামাজিক ইস্যুগুলোকে কারুর বরাত দিয়ে না মেনে বুদ্ধির কাঠগড়ায় দাঁড়ফতে হল। ভলতের, রুশো ব্যাপকভাবে আদৃত হলেন, ফরাসি দেশে ডেভিড হিউম কদর পেলেন। জ্ঞমুক্তঞ্চ বুদ্ধিজীবীদের মতের এক অদ্ভুত সমাগমের পরিবেশে ফরাসি বিপ্লব সংগঠিত হল। ততদিনে ম্যানুফেকচার কাল পার হয়ে পুঁজিবাদ বৃহৎ শিল্পে প্রবেশ করেছে। জ্ঞজ্ঞস্থানিক ইতিহাসঞ্চঞ্চ হয়ে যাচ্ছে জ্ঞজ্ঞবিশ্ব-ইতিহাসঞ্চঞ্চ।
খ.
হয়তো নতুন কোন রূপে
আমাদের ভালবাসা পথ কেটে নেবে পৃথিবীতে
- জীবনানন্দ দাশ
শতাব্দীর শেষ হতেই পাল্টা আক্রমণ এলো। তার সুত্রপাত জার্মান ভূমিতে, কিন্তু শীঘ্রই ছড়িয়ে পড়লো য়ুরোপের চারদিকে। ত্রিশ বছরের যুদ্ধে বিপর্যস্ত জার্মানদের বস্তুগত ও মানসগত অবস্থা ছিল আঘাত খাওয়া। অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক সমৃদ্ধি ছিল অনেক পিছিয়ে পড়া। ফরাসি বিপ্লবের পরে নেপোলিয়নের দখলদারী জার্মানদের মাঝে জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল। নেপোলিয়ন নিজেই ৩০০-র মত ছোট রাজ্যে বিভক্ত জার্মানীকে ৩৯ টি রাজ্যে বাঁধলেন। এই জার্মান সংস্কৃতিতে বুদ্ধিবাদের ব্যবচ্ছেদ শুরু করলেন ইমানুয়েল কান্ট। তার প্রস্তাব ছিল দূর্ধর্ষ। তিনি বললেন, যে বুদ্ধি এত কিছুর দাবি করছে, খোদ তাকেই একবার যাচাই করে দেখা উচিত- তার সম্ভাবনা, সীমা কঞ্চদ্দুর। নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর কান্টের উত্তরসুরী ফিখ্‌টে, শেলিঙ ছিলেন অনেক বেশি জাতীয় চরিত্রের অধিকারী। ফলে জার্মান রাষ্ট্র চিন্তাতে তাদের মতামত অনেকাংশে রাষ্ট্রীয় বিশ্বাস বলে ঘোষিত হয়েছিল। এমনি করে আসলে জার্মান দর্শনের একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরী হচ্ছিল। এই ঘরানা ছিল ক্লান্তিকর, কিন্তু অনেক বেশি গভীর আবেগী, যার সাথে কেবল রুশোর তুলনাই চলতে পারে। জার্মান জাতীয়তাবাদী বোধের অনুসঙ্গ ধরে ফরাসি ইংরেজ বৈঞ্চানিক অভিঞ্চতাতন্ত্রের বিপরীতে জার্মানরা হার্ডার আর হেগেলের মাধ্যমে সামনে তুলে ধরে অধিবিদ্যক ইতিহাসবিগ। এর ভিত ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমালোচনা।
অষ্টাদশ শতাব্দীর ধ্রুপদী দার্শনিকেরা প্রশ্ন তুলেছিলেন যে : ধরা যাক মানুষ প্রকৃতির একটি বিষয়, এর কমও নয়, বেশিও নয়; তাহলে তার আচরণকে কোন নিয়মগুলো শাসন করে? যদি অভিঞ্চতাগত পথে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো আবিষ্কার করা যায়, তাহলে যে সূত্রে মানুষ খায় দায়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে তাও বের করা মোটেই অসম্ভব নয়। যতক্ষণ না এই সূত্রটা আবিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষণ কোন সত্যিকারের সমাজ বিঞ্চানের উদ্ভব হবে না।
এই র‌্যাডিকেল অভিঞ্চতাতন্ত্র হেগেলের কাছে ধর্মতন্ত্রের চাইতেও ক্ষতিকর অন্ধতা বলে মনে হয়েছিল। তার কাছে বোধ হয়েছিল যদি বৈঞ্চানিক পদ্ধতিতে ইতিহাস লেখা হয়, তাহলে ঘটনাগুলোতে ব্যাপক বিক্ষিপ্ততা তৈরী হবে। কিন্তু তত্ত্বায়ন না করে ইতিহাস লিখতে গেলে নিশ্চিত ঐতিহাসিক সংঞ্চা দিয়ে ঐ বিক্ষিপ্ততা এড়ানো যায়। হেগেল ইতিহাসকে দুই মাত্রিক হিসেবে ধারণা করেছিলেন। একদিকে উল্লম্ব মাত্রা- যাতে আছে বিভিন্ন স্তরের ক্রিয়াকান্ডের প্রপঞ্চ। ঐ ক্রিয়াকান্ডগুলো সংগঠিত হয় বিকাশের একই দশায় স্থিত বিভিন্ন জনসমষ্টির মাঝে। তাদেরকে দেখতে হবে এক ধরণের একক নকশায় আন্তঃসম্পর্কিত হিসেবে। ঐ নকশাই প্রতিটি কালকে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র অনন্য চরিত্র প্রদান করে। অপরদিকে আড়াআড়ি মাত্রায় ঘটনার একই ব্যবচ্ছেদকে দেখা হয় একটি উত্তরাধিকারের অংশ, একটি বিকাশ প্রক্রিয়ায় প্রামাণিক দশা হিসেবে। কোন কালকে শুধুমাত্র অতীতের মাধ্যমেই দেখলে চলবে না। কারণ এর মাঝেই আছে ভবিষ্যতের বীজ।
ছোট বীজের ভেতর বিরাট বটগাছের বিকাশের মত করে বিকাশকে অনুধাবন করা, তাদের কে সঠিক পদের মাধ্যমে বিবৃত করার তত্ত্ব এরিস টটলের চাইতেও প্রাচীন। রেনেসাঁসের কালে তা আবার নজরে আসে আর লাইবনিৎজ তাকে সবচাইতে বেশি বিকাশ করেন। বুর্জোয়া ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিবৃত হয় তার মোনাড তত্ত্বে। মোনাড হচ্ছে স্বাধীন, স্বতন্ত্র উপাদান, যাদের প্রত্যেকের স্বাধীন সমগ্র অতীত ও ভবিষ্যত আছে। এই মোনাডগুলো দিয়েই মহাবিশ্ব তৈরী। কোন কিছুই আকস্মিক নয়; আবার অভিঞ্চতাবাদীদের মত কোনকিছুকেই ধারাবাহিক বা অধারাবাহিক পারম্পর্য দিয়েও ব্যাখ্যা করা যাবেনা। খুব বড়জোড় তাদেরকে যান্ত্রিক কারণকার্যের বাহ্যিক সম্পর্ক দিয়ে সংযুক্ত করা চলতে পারে। কোন বিষয়ের সত্য সংঞ্চা হয় জ্ঞপদেঞ্চ, যা ব্যাখ্যা করে কেন ঐ বিষয় তেমন করেই প্রামাণিকভাবে ঐ ভাবেই বিকশিত হয় যেমন করে তা ঐ পদে এর স্বতন্ত্র ইতিহাসে ব্যাখ্যা হয়।
লাইবনিৎজ তার এই আধিবিদ্যক তত্ত্বকে ইতিহাসে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করেননি। হেগেল ভাবলেন একে ইতিহাসেই সবচেঞ্চ ভালোভাবে খাপ খাওয়ানো যায়। কারণ বৈঞ্চানিক কার্যকারণ ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ বলে মানলে ইতিহাস বাহ্যিকভাবে সম্পৃক্ত ঘটনার ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছু থাকেনা। ব্যাখ্যা করা মানে শুধু ঘটনাক্রম প্রদর্শন নয় বরং যৌক্তিক ভিত্তি দেয়া। এভাবে কোন পর্ব কে ব্যাখ্যা করা মানে তাতে যৌক্তিকভাবে অনুধাবনযোগ্য প্রক্রিয়া সত্তা বা সত্তাসমূহের উদ্দেশ্যমুখী ক্রিয়া আরোপ করা। তা মানুষও হতে পারে, ঈশ্বরও হতে পারে। তা না হলে ঐ পর্বটি অ-ব্যাখ্যাত, ভিত্তিহীন, জ্ঞঅর্থহীনঞ্চ রয়ে যায়। কোন যান্ত্রিক মডেল দিয়ে ব্যাখ্যার কাজ সারা গেলেও তাতে যৌক্তিকতা পাওয়া যাবেনা। প্রাকৃতিক বিঞ্চানের সাথেও ইতিহাসের মিল দেয়া যাবেনা। কারণ, যেমন পদার্থ বিঞ্চানে একই প্রপঞ্চ, একই সমন্বয় বার বার একই ফল দেবে, যা মানব ইতিহাসে ভাবাও যায় না।
এই নতুন পদ্ধতি প্রথম বেশ ভালোভাবে প্রয়োগ করেন হার্ডার। য়ুরোপে বর্ধমান জাতি ও জাতীয়তা বোধ আর জার্মান হিসেবে ফরাসি দর্শনে বিতৃষ্ণা থেকে তিনি সমগ্র জাতি এবং সংস্কৃতিতে জৈব বিকাশের ধারণা প্রয়োগ করেন। জাতীয় জার্মান সংস্কৃতি ঘেটে তিনি জার্মান জীবন্ত মানসের ছবি আঁকতে চাইলেন।
হেগেল এই পরিকল্পনা আরো ব্যাপ্ত আর উচ্চাভিলাষীভাবে বিকশিত করলেন। ফরাসি বস্তুবাদীদের ব্যাখ্যা তাঁর কাছে অপর্যাপ্ত লেযেছিল যা দিয়ে স্থিতিশীল প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করা গেলেও গতিশীলকে করা যায়না, ভিন্নতা ব্যাখ্যা করা গেলেও পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায়না। ইতিহাসে বৈঞ্চানিক সূত্র মোতাবেক একই প্রপঞ্চ একই পরিবেশে আনাও যায়না আর আনা গেলেও তা দিয়ে বিঞ্চানের সূত্রের মত একই ফল পাওয়া যায়না। তাই ইতিহাসের কোন নিয়ম থাকলে তা বিঞ্চানের নিয়মের মত হবে না। যেহেতু যা কিছু ধারাবাহিকভাবে অস্তিত্বমান তাদেরই কিছু না কিছু ইতিহাস আছে, সুতরাং সে কারণেই ইতিহাসের সূত্র অস্তিত্বমান সবকিছুর সত্তার সূত্রের সাথে অভিন্ন হবে।
এখন তাহলে প্রশ্ন হল: ইতিহাস সঞ্চালনের এই নিয়ম কোথায় পাওয়া যাবে? যদি বলি এই গতিশীল সূত্র কোন অবোধ্য, অনির্ণেয়, রহস্যময় তন্ত্রে আছে তবে তা হবে মানুষের ব্যর্থতার কৈফিয়ত, বুদ্ধির পরাজয়। যা আমাদের সাধারণ জীবনকে শাসন করে তা আমাদের সাধারণ জীবনের সব অভিঞ্চতার মাঝে উপস্থিত নেই, এতো আরো আশ্চর্য কথা।
এখানে হেগেল খুব চমৎকার করে মাথা খেলালেন। আমরা যাকে বলি ভান্ডের মাঝে ব্রহ্মান্ড ব্যাপারটা তাই। আমাদের কোন একক মানুষের কথা ধরি। এরকম কোন মানুষের চিন্তা আর কাজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আমরা ঐ মানুষের স্বভাব, মেজাজ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য নিয়ে সাধারণভাবে কথা বলি। কিন্তু ওগুলোকে ঐ মানুষটার চিন্তা আর কাজ থেকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বলে মনে করিনা। বরং তারা মানুষটারই প্রকাশ করবার প্রক্রিয়ার সাধারণ ছক। যত বেশি আমরা একটা মানুষকে জানবো তত ভালো করে বুঝবো বাহ্যিক জগতের সাপেক্ষে তার নৈতিকতা, তার মানবিক ক্রিয়া। হেগেল ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বভাবের ধারণা, তার উদ্দেশ্য, লজিক, চিন্তার গুণাবলী, পছন্দ-অপছন্দ, পুরো কাজকারবার আর অভিঞ্চতা যেমন করে নিজেকে মানুষের পুরো জীবন জুড়ে প্রকাশ করে তাকে প্রয়োগ করলেন জাতি আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে খুব চতুর হয়েও হেগেল মানুষের চিন্তা ভাবনার কাছে মানুষকে বন্ধক দিয়ে গিয়েছেন। মানুষের প্রাণশীলতায় স্বয়ং ইতিহাসও প্রাণশীল হয়ে গেল-হেগেল যাকে বলেন জ্ঞপরম ভাবঞ্চ। ঐ জ্ঞপরম ভাবঞ্চ কী? মানুষের জীবনে প্রাণ যেমন প্রপঞ্চের প্রকাশিত হওয়ার পূর্বশর্ত ঠিক তেমনি মানুষের ইতিহাসে ঐ আবশ্যক ক্যাটেগরি হল পরম জ্ঞভাবঞ্চ বা জ্ঞমরমঞ্চ।
হেগেল একটা পদ্ধতি তৈরী করলেন। এখানে মানব স্বতন্ত্র আর তার সংগঠনের সমালোচনা বিরাজমান এক বিশাল সমন্বিত আধা-ব্যক্তিত্ব হিসেবে। এদেরকে, তারা যে স্বতন্ত্র দিয়ে গঠিত তাদের পদ দিয়ে নিখাদ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়না। এই সমীক্ষা তাঁর পরে মারাত্মক সব ধারণা জন্ম দিল; যেমন রাষ্ট্র, জাতি, ইতিহাসকে মনে করা হলে লাগলো অতি-ব্যক্তিত্বের কাজকারবার হিসেবে।
হেগেল মন ও বস্তুর মাঝে কোন আবশ্যকীয় বিরোধ অস্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে স্পিনোজার প্রভাব স্পষ্ট। ইতিহাসকে অব্যক্তিক মরমের বিকাশ বলে চিহ্নিত করায় মানুষের ইতিহাস আশাতিরিক্ত বড় হয়ে গেল। তবে হেগেল কিন্তু মানুষের বস্তুগত কাজকর্মকে অস্বীকার করেন নি। মানুষ এখানে বাস্তব জীবনে কোন জ্ঞপরম ভাবেঞ্চর আত্ম-অনুসন্ধানেরই কাজ করছে। হেগেলের পর পূর্বে পাত্তা না দেয়া বিষয় যেমন, ব্যবসা, পোষাক আশাক, ভাষা, লোক সংস্কৃতি, পুরাণ এসব, মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানগত ইতিহাসের সম্পূর্ণ, জ্ঞজৈবঞ্চ উপাদান হিসেবে গণ্য হতে লাগলো।
লাইবনিৎজের মসৃণ বিকাশের তত্ত্বের সাথে হেগেল একমত ছিলেন না। তিনি সংঘাতের বাস্তবতা ও প্রামাণিক উপর জোর দেন। ফিখটে অনুসারে তার মত হল -প্রতিটি প্রক্রিয়াই অসম্পূর্ণ আর তারা একে অপরের সাথে সংঘাতে জড়ায়। তাদের মাঝের দ্বন্দ্বে তাদের বিকাশ এগোতে থাকে। সেই সংঘাতে অসংখ্য বস্তুগত, মানসিক, প্রাকৃতিক ইত্যাদি উপাদান তাদের নিজস্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কে, দ্বন্দ্বে রূপ নিয়ে চূড়ান্ত রূপে অতীতের ধারাবহিকতাকে ভেঙে দেয়। নতুন স্তরে এই আকস্মিক লাফ পর্যাপ্ত রকম বড় মাত্রায় ঘটলে তাকে রাজনৈতিক বিপ্লব আখ্যা দেয়া যায়। তিনি এই প্রক্রিয়াকে বললেন জ্ঞদ্বান্দ্বিকঞ্চ। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ধারণাতে ইতিহাসের সঞ্চালনের চালিকা শক্তিকে পাওয়া গেল।
চিন্তা হচ্ছে সেই বাস্তবতা যা নিজের সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে। তার প্রক্রিয়া প্রকৃতির স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। প্রকৃতির মাঝে নিরন্তর আত্মসাত আর অস্বীকারের যে খেলা চলছে, তা কোন উদ্দেশ্যহীন প্রক্রিয়া নয়; তার একটা অন্তর্গত লজিক আছে যা উচ্চ থেকে উচ্চতর নিখুঁত অবস্থানে ধাবিত হয়। প্রতিটি বড় মাপের উত্তরণই একটা বৃহৎ বিপ্লবী লাফ দিয়ে এগোয়; যেমন, খৃষ্টানতন্ত্রের উদ্ভব, ফরাসি বিপ্লব। এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই মরম বা সার্বিক ভাব নিজেকে সম্পূর্ণ অনুধাবনের পথে এক ধাপ এগোয়, মানবতাও এক ধাপ এগোয়।
সব মানুষই ভাই ভাই, জাতিগত, বর্ণগত, সম্প্রদায়গত ব্যবধান নিছক ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষার উৎপাদ-এই তত্ত্বের বিকাশ বিদ্যামান সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দিয়ে গেল। এইসব তত্ত্বে বিরুদ্ধে যে সব ভাবনা, ক্রিয়াকান্ড উঠে আসে তা ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায়না। ঐতিহাসিকভাবে তৈরী করা জমি হতেই সংস্কার উদ্যোগ শুরু করতে হবে। বিদ্যমানতাকে অস্বীকার করে বিদ্যমানকে অতিক্রম করা যায় না। সত্যকারের মুক্তি নিহিত আত্ম-প্রথুত্বে, বাহ্যিক নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত হতে পারায়। তা পাওয়া যাবে কেবল-কেউ কি এবং কি হতে পারে তা উদ্‌ঘাটন করতে পারলেই। তার মানেই সেই নিয়ম আবিষ্কার করা যার অধীনে কোন নির্দিষ্ট কালপর্বে স্থানে মানুষ বাঁচে, যে সমাজে সে জ্ঞজৈবঞ্চ ভাবে বাঁচে তার মর্মকে বোঝা। এই সূত্র আবিষ্কার মানে সেই মর্মকে বোঝা যা মানুষের মাঝে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রতিটি প্রজন্মের মাধ্যমে জ্ঞমরমঞ্চ ক্রমান্বয়ে তার শুদ্ধিতায় পৌঁছে। আর তা প্রকাশিত হয় কোন কালের সেই সব মানুষদের মাঝে যারা মহাবিশ্বের সাথে তাদের সম্পর্কের সাপেক্ষে নিজেদের স্বচ্ছ, সুগভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। তার মানে প্রতিকাল পর্বে যথার্থ চিন্তাবিদদের মাঝে।
দর্শনের ইতিহাস হল এই আত্ম-জাগরণের বিকাশের ইতিহাস যাতে, মরম নিজের ক্রিয়া সম্বন্ধে সচেতন হয়। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের ইতিহাস খোদ মরমের আত্ম-জাগরণের গল্প ছাড়া কিছু নয়। এমনি করে সব ইতিহাসই চিন্তার মানে দর্শনের ইতিহাস যা ইতিহাসের দর্শনের সাথে অভিন্ন, যেহেতু তা এই জাগরণেরই জাগরণ। এভাবে করে বুঝলে হেগেলের বিখ্যাত মন্তব্য- ইতিহাসের দর্শনই দর্শনের ইতিহাস - এটি আর দূর্বোধ্য বলে মনে হবেনা।
যারা সমাজে ইতিবাচক কিছু দিতে চান তাদের নিজের পরিবেশকে বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা বিকাশ করতে হবে। এক অর্থে এটাই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন। এর বিকাশ মানেই মানব প্রগতি। এই প্রক্রিয়াকে পরে জ্ঞসমালোচনাঞ্চ নামে ডাকা যায়। হেগেলের ঠিক পরের জার্মান দর্শন পুরোটাই জ্ঞসমালোচনার দর্শনঞ্চ। পরিবর্তনের জন্য রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়া নিম্ন পর্যায়ের মরমের পরিচায়ক।
ফরাসি বিপ্লব য়ুরোপের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচনা করলো। এতে সহিংস প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখল হল আদর্শবাদীদের পক্ষেই। বিপ্লবের তাৎক্ষণিক ব্যার্থতা শুভত্ববাদীদের হতাশায় ফেলে দিল। হেগেল সেখানে এক চমৎকার সমাধান দিলেন এই বলে যে - ব্যার্থতাও প্রগতি প্রক্রিয়ার অন্তর্গত অংশ। এ পরিস্থিতির কারণে সামাজিক মুক্তি ও তা অর্জনে ব্যর্থতার কারণই আচার্য কার্ল মার্ক্সের তরুণ বয়সের লেখার অন্যতম প্রতিপাদ্য।
(গ) মার্ক্সঞ্চর তরুণ বয়সের চিন্তার পরিপার্শ্ব: নব্য হেগেলীয়দের চিন্তার সাথে সখ্য ও সংঘাত
মানুষে মানুষ গাঁথা দেখনা যেমন অলোকলতা
মানুষে না ভজলে পরে খ্যাপারে তুই মূল হারাবি
- ফকির লালন শাহ
হেগেলের জ্ঞপরমভাবঞ্চ নির্বিকার নয়, সক্রিয়। তার সক্রিয়তা চিন্তা বা আরো মোদ্দা কথায় জ্ঞনিজেকে জানায়ঞ্চ স্থিত। পরম ভাবের সক্রিয়তাকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন। ১. নিজের মাঝেই জ্ঞভাবঞ্চর বিকাশ, এর জ্ঞশুদ্ধ চিন্তার উপাদানেঞ্চ মানে লজিকে; যেখানে ভাব নিজের আধেয়কে সমন্বিত লজিকেল ক্যাটেগরিতে প্রকাশ করে। ২. ভাবের জ্ঞঅন্য সত্তাঞ্চর আঙ্গিকে বিকাশ মানে প্রকৃতি বিঞ্চানে। ৩. চিন্তা এবং ইতিহাসে জ্ঞভাবঞ্চর বিকাশ (এখান থেকেই সে জ্ঞমরমঞ্চ) মানে মরমের দর্শনে। এই দশায় পরম ভাব নিজের ভেতরেই এর আধেয়কে মানব বুদ্ধি এবং ক্রিয়ার বিভিন্ন আঙ্গিকে ছেড়ে দেয়, ধারণা করে। তাঁর জ্ঞলজিক বিঞ্চানঞ্চ গ্রন্থে তিনি পরিমাণের গুণগত রূপান্তরের কথা বলে আধেয় আর আঙ্গিক, অংশ আর সমগ্রের দ্বন্দ্বকে রূপায়িত করেছেন। হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্বই হেগেলকে বিপাকে ফেলে দিল। বুর্জোয়া সমাজ বিকাশের মূল সূত্রটা উল্টো করে দেখার ফলে তার কালের বিকাশকেই তার কাছে চরম বলে মনে হয়েছিল।
১৮৩০- ৪০ সালের দিকে জার্মানীর র‌্যাডিকেল বুদ্ধিজীবীদের চরম দূর্দিন যাচ্ছিল। অনেক ভালো ভালো কথা বলে ১৮৪০ঞ্চএ এক প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল রাজা গদিতে বসলো। ১৮৩০ সালের ফরাসি বিপ্লব প্রচেষ্টার পর অষ্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেত্তেরনিখ বিপদজনক চিন্তাভাবনা মোকাবিলা করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে, যা আবার প্রুশিয়ার সরকার সাদরে গ্রহণ করে। তাদের প্রধান অংশই বৃহৎ ভূ-মালিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। কিন্তু তা উদীয়মান শিল্প ও ব্যাংকার অংশকে তেমন দমাতে পারলোনা। তবে প্রেস বা জনসভায় খোলাখুলি কথা বলা ছিল অচিন্তনীয়। সেন্সরশীপও ছিল তুখোড় রকম কার্যকর। হেগেল নিজে শেষের দেকে প্রুশিয়ার রাষ্ট্রকে যে সমর্থন দিয়ে গিয়েছিলেন তা ইতঃমধ্যেই এক তাবেদার দার্শনিক গোষ্ঠী তৈরী করেছিল। তারা বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যাবস্থার সম্পর্কে ভয়ানক রকম সন্তুষ্ট ছিল। তবে এর মধ্য হতে ৩০ এর দশকেই হেগেলের মতের পর্যালোচনা হতে জার্মান উদারনৈতিকরা আত্ম প্রকাশ করলো। পুরনো আর নতুন উভয়পক্ষের হেগেলীয়ঞ্চরাই একমত ছিলেন যে, কোন প্রপঞ্চের বাস্তব ব্যাখ্যা মানেই তার লজিকেল ব্যাখ্যা। কোন কিছুই একই সাথে অশুভ আর জরুরী হতে পারেনা। কারণ যা কিছু বাস্তব তা ন্যায়সঙ্গত হতে হবে, কারণ তা বাস্তব। এ পর্যন্ত দুঞ্চপক্ষই রাজী। কারণ জগতের ইতিহাসই হচ্ছে জগতের ন্যায্যতা। গন্ডগোল বাঁধল হেগেলের বিখ্যাত উক্তি জ্ঞবাস্তবই যৌক্তিক, যৌক্তিকই বাস্তবঞ্চ নিয়ে। যৌক্তিক আর বাস্তব তার মাঝে কোনটায় জোর দেয়া যায়? পুরোনোরা বললো যে বাস্তবতাই যৌক্তিকতার মাপকাঠি। র‌্যাডিকেলঞ্চরা বললো - শুধুমাত্র যৌক্তিকই বাস্তব। তাদের সামনে তখন ফরাসি বিপ্লব, আরো গোটা কয়েক বিপ্লব প্রচেষ্টা, অনেক কিছুই চোখের সামনে পাল্টে যাচ্ছে; ফলে যা বিদ্যামান তা অনেকাংশেই বিদ্যমান মানে আর বাস্তব থাকছেনা। নব্য হেগেলপন্থী মানে র‌্যাডিকেলঞ্চরা খোদ হেগেলে থেকেই নজির টেনে দেখালো যে - স্থান বা কালে ঘটমানতাই বাস্তবতার প্রমাণ নয়। কোন অস্তিত্বমানতা কোন বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার ঘটনা বা অংশ হতে পারে যা বাকী অংশগুলোর সাথে ঐক্যমূলক অবস্থানে নেই। তাহলে ঐ অংশটি মূল প্রক্রিয়ার যে লজিকেল পরিকল্পনা তার বিরোধী। আর অধিবিদ্যাগত দৃষ্টিতে তা বাস্তব নয়, বরং মায়া। কোন কিছু কী পরিমাণ বাস্তব তা পরিমাপিত হবে কোন যৌক্তিক সমগ্র সৃষ্টিতে তাদের প্রবণতা থেকে। ফলে যৌক্তিকতার পথ নির্দেশে কোন বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের র‌্যাডিকেল রূপান্তর প্রয়োজন হতেই পারে। আর হেগেল তো নিজেই বলে গেছেন যে - বাস্তবতা একটি প্রক্রিয়া, আত্ম-চৈতন্য বৃদ্ধি সাথে সাথে পোক্ত হয়। আর প্রগতি হচ্ছে পরস্পর বিরোধীদের উত্তেজনার ফল, তা যে মসৃণ হবে এমন কোন কথা তো নেই। অতএব, যে দার্শনিক সভ্যতার বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছেন তার দায়িত্ব হচ্ছে বিশেষ কলাকৌশল দিয়ে সেই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা। মানেই একটা তুমুল বৌদ্ধিক লড়াই।
তবে তারা সাধারণ জনসমষ্টিকে উত্তেজিত করতে ঘোর নারাজ ছিলেন। করণ জনসমষ্টি হচ্ছে মানুষের মাঝে মরমের অর্জিত নিম্নতম আত্ম-চৈতন্য, ফলে তারা অযৌক্তিক কাজ করে বসবে যার পরিণাম হবে আরো অযৌক্তিক। আর ভাবের মাঝে বিপ্লব হলে তা নিজই প্রয়োগে বিপ্লব আনবে। অমূর্ত্ত্ব তত্ত্বের পেছেনে চর্চা বস্তুকৃত হয় নিজের সাধ্য অনুসারে। সুতরাং নব্য হেগেলীয়ঞ্চরা তাদের তত্ত্বগুরুর সমালোচনায় নামলেন। এই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মহরত ঘটলো ডেভিড স্ট্রসঞ্চর জ্ঞযিশুর জীবনঞ্চ (১৮৩৫) গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ওইখানে বাইবেলের গসপেলগুলোকে তিনি মিথের ক্যাটেগরি ব্যবহার করে তার মাঝ দিয়ে জ্ঞমরমেরঞ্চ ঐতিহাসিক স্তর ব্যাখ্যার চেষ্ট করেছিলেন। তার বৈশিষ্ট্য হল- এখানে যেন মরমের সাপেক্ষে জ্যান্ত, ক্রিয়াশীল মানুষ একটু বেশি রকম উঁকি মারছিল। মিথকে তিনি বললেন একটা নিদিষ্ট ঐতিহাসিক কালপর্বে কোন সংগঠিত মানব সংগঠনে জ্ঞঅচেতন চৈতন্যঞ্চ। এখানে মানুষ হেগেলের দর্শনের মানুষের চাইতে বেশ কিছুটা স্বাধীন। পরম মরমের সাপেক্ষে মানুষের নিজেরও কিছুটা স্বাধীন অংশীদারী আছে।
ডেভিড স্ট্রসের পর থেকে নব্য হেগেলীয়রা শুরু করলেন সমালোচনার দর্শন। যেহেতু স্বাধীনভাবে লেখালেখি ছিল নিষিদ্ধ তাই তারা প্রচলিত ব্যবস্থাকে একটু ঘুরিয়ে আক্রমণ করতে মনস্থ করলেন। অর্থোডক্সির বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই তাই অনুষ্ঠিত হল খৃষ্টান ধর্মতত্ত্বের মাঝে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধর্মতত্ত্ব বিভাগে। স্ট্রস যিশুকে প্রতিপন্ন করতেন সাধারণ একজন ঐতিহাসিক মানুষ হিসেবে, যার মাঝে তার কালের সংশ্লিষ্ট জনসমূহের আশা-আকাঙ্খা মিথের আকারে প্রতিফলিত হয়েছে। ধর্ম কে মিথ্যা চৈতন্যের আঙ্গিক হিসেবে সমালোচনার পরবর্তী ধাপে হাল ধরেন ব্রুনো বাউয়ের। তিনি খোদ যিশুর অস্তিত্বের বাস্তবতাই অস্বীকার করলেন। তত্ত্বই বাস্তব প্রয়োগে পরিবর্তন আনবে, তাই বাউয়ের বললেন যে, দর্শনের কাজ হচ্ছে বিদ্যমান বাস্তবতার যে বৌদ্ধিক রূপ ও ইতিহাস, তার সমালোচনামূলক দর্শন দাঁড় করানো। নব্য হেগেলীয়রা যে চর্চা করছিলেন তা ছিল ধর্মের প্রতিরূপে দাঁড় করানো সমাজ চৈতন্যকে সমাজ কাঠামো হিসেবে বিশ্লেষণের প্রথম প্রয়াস।
স্ট্রস এবং বাউয়ের এর পর এই ধারায় আরো তীক্ষ্ণতর রূপ আনলেন ম্যাক্স স্টার্নার। তার আসল নাম ছিল য়োহান ক্যাসপার স্মিড। তিনি হলেন নৈরাজ্যবাদী তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠাতা, যা পরে বাকুনিনের মাধ্যেমে বাস্তব আন্দোলনে রূপ লাভ করে। সমাজবদ্ধ মানুষের মাঝে ক্রিয়াশীল জ্ঞমরমঞ্চ কে তিনি আরো স্বতন্ত্র আর একলা করে দেখালেন। তাঁর কাছে অহংবাদী জ্ঞআমিঞ্চই একমাত্র বাস্তবতা, পুরো জগতই তার অধিকারে। স্বতন্ত্রই সব নৈতিকতা, নিয়মের উৎস। সমাজ ব্যক্তিসম্পত্তি থাকতে হবে; কারণ তাতে অহং-এর আমিত্ব প্রকাশিত হয়। অহংবাদীদের সম্মিলন হল স্টার্নারের সামাজ আদর্শ যেখানে, প্রত্যেক অহংবাদী অন্যকে দেখে তার লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবে। ইতিহাসকে ভাবের উৎপন্ন বর্ণনা করে তিনি বললেন-দাপুটে ধারণাগুলোকে অতিক্রম করে আমরা সমাজ সম্পর্ক বদলাতে পারি।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, নব্য হেগেলীয়দের মধ্যে মরম আর মানুষের অংশীদারীতে কার ভাগ কতটা তা নিয়ে আলোচনায় ক্রমশ মানুষের দিকেই পাল্লা ঝুঁকছিলো। মরমের কবরে শেষ কোদাল মাটি দিলেন ফয়েরবাখ। স্টার্নারের অহংবাদের বদলে তিনি আরো বড় ক্যানভাস বেছে নিলেন। এই দার্শনিক খাতার নাম জ্ঞনৃতত্ত্ববাদঞ্চ। এখানে মানুষ হল প্রকৃতির সর্বোচ্চ উৎপন্ন। মানুষের সব বৈশিষ্ট্য গুণকে ব্যাখ্যা করা হল তার প্রকৃৃতি গত উৎপত্তিঞ্চর ভিত হতে। ১৭ঞ্চশ আর ১৮ঞ্চশ শতাব্দীর য়ুরোপীয় নৃতত্ত্ববাদ থেকেই শরীর আর মনের দ্বৈতবাদী বিচ্ছিন্নতাকে প্রত্যাখান করা হত। সেই সময় এই মত ছিল মানসের বাস্তব প্রকৃতিঞ্চর সাথে ধর্মীয় ব্যাখ্যা আর সামন্ত উৎপাদন সম্পর্কের অসঙ্গতি প্রতিপন্ন করার একটা মোক্ষম যুক্তি। এখানে বিমূর্ত মানুষের দার্শনিক অধ্যয়ন করা হত সামাজিক সম্পর্কের সমগ্রের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে। সমাজ বিকাশের যে বিষয়গত সূত্র তারা উপস্থাপন করতেন তা ছিল সারসত্তার দিকে দিয়ে মানুষকে অধ্যয়ন করার একটা জৈব প্রস্তাবনা।
ফয়েরবাখের আরম্ভ বিন্দু ছিল হেগেলের মানব সারসত্ত্বাকে আত্ম-চৈতন্যে পর্যবাসিত করার অস্বীকৃতি। তিনি ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন যে, বুদ্ধি কাজে লাগানোর আগে মানুষকে খেতে হয়। এই প্রয়োজন মেটানোর নিশ্চয়তা দেয়া যেতে পারে কেবলমাত্র বাস্তব উৎপাদনের উপায়গুলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। হেগেল বলেছিলেন, কোন একই প্রদত্ত কালপর্বের মানুষদের চিন্তা এবং চিন্তা নির্ধারিত হয় তাদের মাঝে প্রকাশমান, ক্রিয়াশীল অভিন্ন মরমের দ্বারা। ফয়েরবাখ তীব্রভাবে তা খারিজ করলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন - যে প্রপঞ্চগুলো সামগ্রিকভাবে কোন কাল বা সংস্কৃতি তৈরী করে, তাদের কোন দুনিয়াছাড়া নাম ব্যতিরেকে অন্য কোন মর্মে কি ব্যাখ্যা করা যায় না? হেগেলের ব্যাখ্যার অনুপাতে প্রশ্নটা খুব তেজি সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রশ্নটার মাঝেই একটা উত্তর আছে। প্রপঞ্চগুলো নিজেরা যা তাদের সম্পর্কের মাঝ দিয়ে তা হওয়াই ছিল তাদের নিয়তি, তারা তাদের সমগ্রতা দিয়েই নির্ধারিত। মামলা সুরাহা হলনা। তখন তিনি সমগ্রতার বদলে একটা নকশা প্রয়োগ করলেন। কারণ নকশা সক্রিয় কারণ ঘটাতে পারে না, নকশা একটা আঙ্গিক, ঘটনার আরোপ, যে ঘটনা খোদ নিজেই ঘটে অন্য কারণ দিয়ে। ফরাসি বিপ্লব, রেনেসাঁ মর্ম এগুলো জটিল গুণাবলী আর ঐতিহাসিক ঘটনার একটা লেবেলে ছাপা নামে অমূর্তকরণ ছাড়া আর কী? কিন্তু এইসব নামে জগতের বাস্তব অধিবাসীরা কোথায়, যারা এসব ঘটায়, চাইলে পাল্টেও দেয়? হেগেলে তাই এই দৃষ্টিভঙ্গি বিরোধিতা করেছেন। কারণ তা বিশাল আকারের জীবন্ত, সক্রিয় স্বতন্ত্রে মিথস্ক্রিয়া হতে কেমন করে এই সমগ্র ফল বের করে আনে সে কথা ব্যাখ্যা করতে পারেনা । এইসব স্বতন্ত্রদের সাধারণ ইচ্ছা নির্দিষ্ট গতির জন্য দায়ী কোন একক শক্তি খুঁজতে গিয়ে তাই হেগেল জিনিয়াসের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্ত শেষে এসে তিনি আর যৌক্তিক থাকতে পারেননি। হেগেলের জ্ঞভাবঞ্চ তত্ত্ববিদ্যাগত সংস্কার না হলেও তা ছিল খৃষ্টানদের ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ছদ্মবেশ। ফয়েরবাখ এতদূর এসে ঘোষণা করলেন ইতিহাসের চালিকাশক্তি মরমী নয়, বরং কোন প্রদত্ত কালে বেঁচে থাকা মানুষদের চিন্তা এবং কাজ করায় (তার ঐ কালে যেমন করে) যে বাস্তব শর্ত বিদ্যমান থাকে, তাদের সমগ্র যোগফলই ইতিহাসের চালিকা শক্তি। মানুষের বাস্তব দূর্দশাই মানুষকে বাধ্য করে তাদেরই তৈরী অবাস্তব আদর্শ জগতে শান্তি খুঁজতে। যেখানে তারা পৃথিবীর জীবনে কাটানো অশান্তির বিনিময়ে অনন্ত আশীর্বাদধন্য সুখ ভোগ করবে। সুখ, শান্তি, নিশ্চয়তা, ন্যায়বিচার এ জগতে তাদের যা কিছুর অভাব, সবগুলোকেই মানুষ অতিন্দ্রিয় জগতের অতিন্দ্রিয় গুণ বলে ভাবতে ভাবতে বাস্তব বলে উপাসনা করতে থাকে। অতিন্দ্রিয়তার বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের প্রবল বিতৃষ্ণা ছিল। তিনি পরিষ্কার বললেন জ্ঞমানুষ যা খায়, মানুষ তাই (ঈনক্ষ খনশড়দব ভড়ঢ় ংতড় নক্ষ ভড়ড়ঢ়)। মানব ইতিহাস হল মানব সমাজের ওপর পদার্থগত পরিবেশের প্রবল প্রভাবের ইতিহাস। তাই পদার্থগত জগতের সাপেক্ষে নিজেদের জীবনকে গ্রহণ করার মাধ্যমে পদার্থগত ঞ্চান অর্জনের মাধ্যমেই এসব শক্তির উপর প্রভুত্ব অর্জন করা যেতে পারে। আর ধর্মীয় বা ইহজাগতিক, সব ভাবদর্শই প্রায়শ বাস্তব দূর্দশার ভাবগত ক্ষতিপূরণ, যা তাদের বাস্তব জীবনকে ধোঁয়াশা করে দেয়।
এতদূর পর্যন্ত মার্ক্সের দর্শনে ফয়েরবাখ যে ভূমিকা পালন করেছেন সেই ভূমিকা এর আগে য়ুরোপীয় দর্শনে পালন করেছেন কান্ট। মানে ক্রম-ঘনীভূত একটা দার্শনিক সমস্যার আগপাশ সাফাই করার কাজ সারলেন ফয়েরবাখ। হেগেলের চৌহদ্দীতে থেকে এর বেশি এগোনোর কথাও না। ধর্মের আঙ্গিকে সমাজ সংগঠনকে ব্যাখ্যার এই শেষ বীর সমস্যার যে সমাধান দিলেন তা হল - সচেতন আত্ম-চৈতন্য দিয়ে অচৈতন্যকে প্রতিস্থাপিত করা। এর চূড়ান্ত মানে আসলে বুদ্ধিবাদীদের আগের বলা সেই শিক্ষার অনিবার্যতা, শেষ নাগাদ তিনি নতুন একটা ধর্মের প্রয়োজনীয়তার কথাও প্রচার করেন।
জার্মান ভাবাদর্শঞ্চর প্রেক্ষাপট
বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্ক্স পড়ালেখা শুরু করেন আইনের ছাত্র হয়ে। ওখানে সেভিগনি পড়াতেন জুরিসপ্রুডেন্স। তিনি ছিলেন জুরিসপ্রুডেন্সের ইতিহাসগত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা, হাড়ে-মাংসে উদারনৈতিকতা বিরোধী, প্রুশিয়ান কেন্দ্রীগত শাসনের ঘোর সমর্থক। সেভিগনির লেকচারে মার্ক্স দুই টার্মে যোগ দিয়েছিলেন খুব নিয়মানুবর্তীতার সাথে। এই শিক্ষক ঐতিহাসিক কোন সিদ্ধান্ত টানার জন্য খুঁটিনাটি তথ্যের উপর জোর দিতেন। সেভিগনির পেশাদার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এদুয়ার্দ গ্যানস, হেগেলের প্রিয়শিষ্য, কবি হাইনের বন্ধু, মানবতাবাদী র‌্যাডিক্যাল; আর তিনি ফরাসি আলোকায়ন প্রসঙ্গে হেগেলের তাচ্ছিল্য মানতেন না। তাঁর প্রভাবে মার্ক্স জুরিসপ্রুডেন্সে ইতিহাস দর্শনের ব্যাপক প্রয়োগের সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। বিনিদ্র রাত, বিশ্রামহীন দিন কাটতে লাগলো নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করানোর চেষ্টায়। অসুস্থ হয়ে বার্লিন ছাড়লেন। অস্থির হয়ে ফিরে এলেন। তিন সপ্তাহ রাত দিন ফারাক না মেনে চুল-চেরা অধ্যয়ন চললো হেগেল রচনাবলীর । তার পর তিনি নব্য হেগেলীয়দের পথে নিজেকে মতান্তরিত ঘোষণা করলেন, গ্র্যাজুয়েট ক্লাবের সদস্য হলেন। আইন পড়া ছেড়ে দর্শন নিলেন; কারণ আর কোন বিষয় বর্তমানকে ধারণ করতে পারছেনা। পরিকল্পনা নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হবেন। ব্রুনো বাউয়েরঞ্চর সাথে তীব্র নাস্তিত্যবাদী লেখা লিখতে লাগলেন নরমপন্থীদের বিনাশের জন্য। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি খরচ বলে জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনেই ডক্টরেট ডিগ্রী নিলেন। বিষয়টাও নব্য হেগেলীয় বন্ধুদের সাথে আলোচনা করেই ঠিক করা - জ্ঞডেমোক্রিটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের মধ্যে পার্থক্যঞ্চ। এর মধ্যে ব্রুনো বাউয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী হারালেন; মার্ক্সের বাবা যৎসামান্য সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। প্রুশিয়ার শিক্ষামন্ত্রী নব্য হেগেলীয়দের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা রদ করলো; মার্ক্সের জন্য প্রথাগত পথের দ্বার চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
মোসেস হেস নামে মার্ক্সের এক অনুরাগী চিঠিতে মার্ক্সের পরিচয় ঐ সময় এমন করে দিচ্ছেন জ্ঞজ্ঞডক্টর মার্ক্স - এটাই আমার আদর্শ মানুষটার নাম, বয়স এখনো কম (খুব বেশি হলে চব্বিশের কাছাকাছি)....। তাঁর মাঝে আছে গভীর দার্শনিক গাম্ভীর্যের সাথে ধারালো তীক্ষ্ণ কথার মিশেল। কল্পনা করো রুশো, ভলতের, হলবাখ, লেসিঙ, হেইন এবং হেগেল একটা মানুষের মাঝে মিশে গেছে - খেয়াল কর মিশে গেছে, স্তুপ করে রাখা না - তাহলেই তুমি বুঝে যাবে ডক্টর মার্ক্স কেমন।ঞ্চঞ্চ এই হেস কলোন থেকে রাইনিশ গ্যাজেট নামে র‌্যাডিকেল পত্রিকা বের করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। নিয়মিত লেখক থেকে মার্ক্স দশ মাসে এর প্রধান সম্পাদক হলেন, এটাই ছিল তার প্রথম সরাসরি রাজনীতি। পত্রিকাতে তীক্ষ্ণভাবে সেন্সর আইন, ফেডারেল শাসন পরিষদ, ভূ-মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লেখা পত্রিকার জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়িয়ে দিল। এপ্রিল ১৮৩৪ সালে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হল। ঐ মাসেই তিনি বিয়ে করলেন। জেনী ভেস্টাফলেন কনে।
বিয়ের পর তারা ফ্রান্সে পাড়ি জমালেন। পিছিয়ে পড়া জার্মানীতে এমন তাঁর হাঁসফাঁস লাগছিলো। ১৮৪৩ সনেই আর্নল্ড রুগের কাছে মার্ক্স লিখছেন জ্ঞজ্ঞতলোয়ারের বদলে সূঁচ নিয়ে যুদ্ধসাজ সেজে, এমনকি মুক্তির খাতিরেও হামাগুড়ি দিয়ে চলা সহজ না: আমি এই সব ভন্ডামি আর নির্বুদ্ধিতায়, প্রশাসনের একঘেয়েমীতে ক্লান্ত। আমি ক্লান্ত এই মাথা নোয়ানো, তেলবাজী আর নিরাপদ, ক্ষতিহীন বুলি আবিষ্কারের কারখানায়। জার্মানীতে আমার করার মত কিচ্ছু নেই.... জার্মানীতে কেউ শুধু নিজের কাছে মিথ্যেবাদীই হতে পারেঞ্চঞ্চ। ১৮৪৩-৪৫ সালের মাঝে পারীঞ্চতে তাঁর বৌদ্ধিক রূপান্তর চূড়ান্ত হল।
ততদিনে পুরোনো সব বন্ধুদের কাছ থেকে ইচ্ছে করে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। ১৮৪৪ সালে রুগের সাথে জার্মান-ফরাসি জার্নাল সম্পাদনায় যোগ দেন। এতে প্রকাশিত জ্ঞইহুদী প্রশ্নেঞ্চ এবং জ্ঞজ্ঞহেগেলীয় আইন দর্শনের পর্যালোচনা প্রসঙ্গে সন্নিবেশঞ্চঞ্চ রচনায় প্রথম বারের মত মার্ক্সের সাম্যবাদী মত দৃঢ়ভাবে প্রকাশিত হয়। মোসেস হেসঞ্চর মাধ্যমে এঙ্গেলস নামে আরেকজন বিপ্লবী তরুণের নাম মার্ক্সের জানাই ছিল। তাঁর কাছ থেকে পাঠানো উদারনৈতিক অর্থনীতিক তত্ত্বের সমালোচনা পড়ার পর ১৮৪৪ হেমন্তে পারীতেই তাদের দেখা হয়। দুঞ্চজনেই নিজেদের মতের ঘনিষ্ঠতায় অবাক, খুশি হলেন। তাঁর কাছ থেকে মার্ক্স যোগান পেলেন সবচেঞ্চ প্রাগ্রসর প্রলেতারীয় জ্ঞচার্টিস্টঞ্চ আন্দোলনের বৈশ্লেষণিক তথ্য, মালমশলা। ততদিনে সমালোচনা দর্শনের নামে নব্য হেগেলীয়দের বাক্যবাগীশতায় তিনি বীতশ্রদ্ধ, তাই পরিপূরকের খোঁজে ফরাসি বিপ্লব আর সাঁ সিমো, সুইস বুদ্ধিজীবী সিসমঁদিঞ্চর রচনাবলী পাঠ করে অর্থনৈতিক পাঠে নিজস্ব প্রকরণ ও পদ্ধতি দাঁড় করানোর জন্য দানবিক শ্রম দিতে লাগলেন। তবে মার্ক্স নির্বিচার সমালোচনার নাম খারিজ করার লোক ছিলেন না। তিনি মানতেন যে, আধুনিক জার্মান রাষ্ট্রকে তার দর্শনে বিশ্লেষণ করা যায়, দর্শনই হচ্ছে রাষ্ট্রের জ্ঞজ্ঞস্বপ্ন ইতিহাসঞ্চঞ্চ। তিনি লিখছেন জ্ঞজ্ঞদার্শনিকদের মগজেই বিপ্লব শুরু হচ্ছেঞ্চঞ্চ। এই পর্বে লেখা এঙ্গেলসের প্রবন্ধ জ্ঞজ্ঞরাষ্ট্রীয় অর্থনীতির পর্যালোচনার রূপরেখাঞ্চঞ্চতে ছিল সম্পর্ক শাস্ত্র হিসেবে মার্ক্সের জীবনব্যাপী অর্থনীতি অধ্যয়নের যাত্রাবিন্দু।
ফরাসি দেশে কাটানো মার্ক্সের এই কালটির অদ্ভূত ফল হচ্ছে জ্ঞজ্ঞ১৮৪৪-এর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়াঞ্চঞ্চ। মার্ক্স-এঙ্গেলস দুঞ্চজনে মিলে ১৮৪৫ সালে প্রকাশ করলেন জ্ঞজ্ঞপবিত্র পরিবার বা সমালোচনামূলক দর্শনের সমালোচনাঞ্চঞ্চ- বইটিতে ঐ সময়কার য়ুরোপের বিপ্লবী আন্দোলন ও তত্ত্বের নিরিখে নব্য হেগেলীয়দের তীব্র শ্লেষাত্মক পর্যালোচনা ছিল। এই সমালোচনার মাঝেই রূপ নিচ্ছিলো তাদের নিজস্ব মত। বইটা দুজন লিখেছিলেন আলাদাভাবে, প্রধান অংশ মার্ক্সই লিখেছিলেন। এরপর এঙ্গেলস ফিরে গেলেন ইংল্যান্ডে। ১৮৪৫ সালে ছাপা হল তাঁর বই জ্ঞজ্ঞ১৮৪৪ সালে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থাঞ্চঞ্চ। শ্রমিক শ্রেণী, বুর্জোয় বিকাশ, সংগঠন কৌশলের যে থিসিস জ্ঞপবিত্র পরিবারেঞ্চ মার্ক্স উপস্থাপন করেছিলেন তার মূর্ত প্রয়োগ হল এঙ্গেলসের সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে।
১৮৪৫ সালে ব্রাসেলসে মার্ক্সের আরেক সদ্য নির্বাসনে, বসন্তকালে যোগ দিলেন এঙ্গেলস। দুজনে মিলে শুরু করলেন পুঁজিবাদের ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীদের রচনা আর সমাজতন্ত্রীদের মতবাদের ব্যাপক অধ্যয়ন। গ্রীষ্মে দুঞ্চজনে মিলে গেলেন ইংল্যান্ডে। মার্ক্সের সাথে পরিচয় হল চার্টিস্ট আন্দোলনের নেতাদের; সেই ফাঁকে হজম হতে লাগলে ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের তত্ত্ব আর রচনা। এই পর্বের ফসল হচ্ছে জ্ঞজ্ঞজার্মান ভাবাদর্শঞ্চঞ্চ, লেখা শেষ হয় ১৮৪৬ এর গ্রীষ্মে। মার্ক্সের হেগেল ও হেগেলীয় পর্বের সাথে চূড়ান্ত বোঝাপড়া শেষ হল।
লেখকদের জীবিতকালে রচনাটির শেষ অংশই কেবল ছেপে বেরিয়েছিল, প্রকাশক সংকটই ছিল তার কারণ। বাকী পান্ডুলিপি রয়ে গেল জ্ঞনেংটি ইঁদুরদের দাঁতের সমালোচনাঞ্চর জন্য; কারণ জ্ঞজ্ঞনিজেদের স্বচ্ছঞ্চঞ্চ করার উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে। এঙ্গেলস পরবর্তীতে তাঁর জ্ঞজ্ঞলুডভিগ ফয়েরবাখ ও ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের পরিণতিঞ্চঞ্চর মুখবন্ধে জার্মান ভাবাদর্শ সম্পর্কে বলছেন জ্ঞজ্ঞ ফয়েরবাখ নিয়ে এতে যে অংশ আছে তাসম্পূর্ণ নয়ঞ্চঞ্চ। তবুও পুরো লেখাটাতে জ্ঞফয়েরবাখঞ্চ অংশটিই সবচাইতে বিস্তৃত ও মৌলিক, যার মাঝে পলেমিকাসের চাইতে লেখকদের নিজস্ব বিশ্লেষণই উঠে এসেছে।

পরবর্তী অংশ