Marxists Internet Archive
Bangla Section


ডেমোক্রেটিয় ও এপিকিউরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

দ্বিতীয় অংশ: বিস্তারিতভাবে ডেমোক্রিটিয় ও এপিকিউরিয় পদার্থবিদ্যার পার্থক্য

চতুর্থ অধ্যায়: কাল
যেহেতু বস্তু পরমাণুর মধ্যে এর সাথে খাঁটি সম্পর্কের নিরিখে সকল আপেক্ষিকতা এবং পরিবর্তনশীলতা থেকে রেহাই পায়, সেহেতু এর অব্যবহিত ফল হচ্ছে- সারসত্তার জগত থেকে, পরমাণুর ধারণা থেকে কাল কে বাদ দেয়া। বস্তু ততদূরই শাশ্বত এবং স্বাধীন, যতদূর এর মধ্যে জ্ঞঅমূর্ততাঞ্চ কাল মুহূর্তের তৈরী। ডেমোক্রিটাস এবং এপিকিউরাস এতে একমত। যেখানে কাল পরমাণুর জগত থেকে অপসারিত হয়ে নির্ধারিত হবে, না স্থানান্তরিত হবে এই প্রশ্নে আসে, সেখানেই তারা ধরণের ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন।
পদ্ধতির জন্য কালে কোন গুরুত্ব অথবা প্রামানিকতা ডেমোক্রিটাসের কাছে নেই। তিনি কাল কে ব্যাখ্যা করেন এই পদ্ধতিটিকে অস্বীকার করার জন্য। এরিস্টটল এবং সিমপ্লিসিয়াসের বর্ণনার মতো এটা চিরন্তনভাবে নির্ধারিত হয়, যেহেতু উত্থান এবং অবসান কালগত, সেহেতু তা পরমাণু থেকে অপসারিত হয়। কাল নিজেই প্রমাণ করে যে, প্রত্যেক কিছুর একটি উৎপত্তি- প্রারম্ভের একটি মুহূর্ত থাকা জরুরী নয়।
এই অবধারণা থেকে আরো গভীর কিছু চিহ্নিত করা যেতে পারে। যে উপাদানের মুক্ততা জ্ঞকল্প-কৃতঞ্চ মেধা ধারণ করে না, তা কালের মাঝে নিজের হয়ে উঠাকে অনুসন্ধান করে। এটা অনূধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে, উপাদানকে পার্থিব করে এটা কাল কেও দেহী করে তোলে; এবং এভাবে এর ধারণাকে অস্বীকার করে। কারণ, কালকে অসীম করলে তা আর দেহী থাকে না।
কিন্তু অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমাধান সন্তোষজনক নয়। কারণ সারসত্তার জগত থেকে জ্ঞবহিঃস্কৃতঞ্চ কাল বিষয়ীর দর্শনায়িত করণের আত্ম-চৈতন্যে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু সে নিজেই জগতের সাথে কোন সংস্পর্শ তৈরী করে না।
এপিকিউরাসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একদম অন্যরকম। সারসত্তার জগত থেকে বহিঃস্কৃত কাল তাঁর কাছে প্রতিভাসের পরম আঙ্গিকে পরিণত হয়। বলতে গেলে, কাল জ্ঞঅবান্তরের লক্ষণেঞ্চর জ্ঞঅবান্তর লক্ষণঞ্চ হিসেবে নির্ধারিত হয়। জ্ঞঅবান্তরের লক্ষণঞ্চ হচ্ছে সাধারণভাবে উপাদানের পরিবর্তন। জ্ঞঅবান্তরের লক্ষণের অবান্তরর লক্ষণঞ্চ হচ্ছে পরিবর্তন হিসেবে পরিবর্তন; অথবা সেই পরিবর্তন, যা এর নিজের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। প্রতিভাসের জগতের এই খাঁটি আঙ্গিকই হচ্ছে কাল।
বিন্যাসসজ্জা হচ্ছে নিরেট প্রকৃতির নিষ্ক্রিয় আঙ্গিক মাত্র; এর সক্রিয় রূপ হচ্ছে কাল। যদি আমি এর সত্তার মধ্যে বিন্যাসসজ্জাকে বিবেচনা করি, তাহলে এর অতীতে শূন্যের মধ্যে, কল্প-দৃষ্টির মধ্যে পরমাণু অস্তিত্বমান। যদি পরমাণুকে তার ধারণার সাপেক্ষে বিবেচনা করি, তাহলে এই বিন্যাসসজ্জা হয় একেবারেই অস্তিত্বশীল থাকবে না; নতুবা শুধুমাত্র বিষয়ীগত কল্প-দৃষ্টির মধ্যে অস্তিত্বমান থাকবে। কারণ, বিন্যাসসজ্জা হচ্ছে একটি সম্পর্ক, যার মধ্যে পরমাণুসমূহ স্বাধীন, স্ব-বেষ্টিত; যেমনিভাবে এদের একটি অন্যটির প্রতি অনাগ্রহী, তেমনি, একইভাবে এরা পারস্পরিক সম্পর্কহীন। বিপরীতে, কাল হচ্ছে সসীমতার সীমা পর্যন্ত সেই পরিবর্তন, যে পরিবর্তন প্রদর্শিত হয় পরিবর্তন বলে। এবং এটা ঠিক ততটাই বাস্তব আঙ্গিক, যা প্রতিভাসকে সারসত্তা থেকে পৃথক করে এবং সারসত্তাতে প্রত্যাবর্তিত করার কালে একে প্রতিভাস হিসেবে উপস্থাপন করে। বিন্যাসসজ্জা পরমাণুর বস্তুময়তা প্রকাশের সাথে সাথে তাদের থেকে উত্থিত প্রকৃতিও প্রকাশ করে। বিপরীতে, সারসত্তার জগতে পরমাণুর ধারণা যা, প্রতিভাসের জগতে কালও তা-ই। সোজা কথায়, নির্ধারিত সব সত্তাই নিজের জন্য সত্তায় অমূর্ততা, ধ্বংস এবং রূপান্তর।
এই জ্ঞচলমানঞ্চ পর্যবেক্ষণগুলো থেকে এই সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে। প্রথমত: এপিকিউরাস বস্তু এবং আঙ্গিকের এই দ্বন্দ্বকে প্রতিভাসের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যে পরিণত করেন, যা এভাবে সারসত্তার বিপরীত মূর্তি, মানে পরমাণুতে পরিণত হয়। এটা করা হয় কাল দ্বারা; যেহেতু তা থাকে স্থানের বিপরীতে, যে স্থান নিষ্ক্রিয় আঙ্গিকে প্রতিভাসের সক্রিয় আঙ্গিক রূপে বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত: এপিকিউরাসই সর্বপ্রথম প্রতিভাসকে প্রতিভাস হিসেবে হৃদয়ঙ্গম করেন। তার মানে তা সারসত্তার বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিজেকে ঐ রকমই বিছিন্নতার মতো বাস্তবতায় সক্রিয় করা। অন্যদিকে, ডেমোক্রিটাসের কাছে (যিনি বিন্যাসসজ্জাকে বিবেচনা করেন প্রতিভাসের প্রকৃতির একমাত্র আঙ্গিক হিসেবে) প্রতিভাস নিজের বুক ঠুকে বলে না যে, প্রতিভাস সারসত্তা থেকে কিছু পরিমাণ পৃথক। এভাবে প্রতিভাসকে যখন এর অস্তিত্বের সাপেক্ষে বিবেচনা করা হয়, সারসত্তাগুলো এর সাথে সম্পূর্ণ মিশে যায়। আর এর ধারণার সাপেক্ষে বিচার করা হলে সারসত্তাগুলো অস্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। সে কারণে এটা বিষয়ীগত সাদৃশ্যের স্তরে নেমে যায়। বিন্যাসসজ্জা তার অপরিহার্য ভিত্তিগুলোর প্রতি অভিন্ন এবং বস্তুগত আচরণ করে। অন্যদিকে কাল হচ্ছে সারসত্তার আগুন; যা অনাদীকাল ধরে প্রতিভাসকে গিলে ফেলে, নির্ভরশীলতা এবং অ-সারসত্তাগুলো দ্বারা এতে চাপ দেয়। শেষত: যেহেতু এপিকিউরাস অনুসারে কাল হচ্ছে পরিবর্তনের হিসেবে পরিবর্তন, প্রতিভাসের নিজের মধ্যেই প্রতিফলন; এবং যেহেতু প্রতিভাসের প্রকৃতিকে যথাযথভাবে বিষয়গত হিসেবে মেনে নেয়া হয়; তাই সংবেদন হচ্ছে যথাযথভাবে তৈরীকৃত নিরেট প্রকৃতির সত্যিকারের মানদন্ড। যদিও পরমাণু এর ভিত্তি, তবু পরমাণু শুধুমাত্র বুদ্ধি দিয়েই অনুভূত হয়।
বস্তুত কাল সংবেদনের অমূর্ত আঙ্গিক; তাই এপিকিউরিয় চৈতন্যের পরমাণুবাদ অনুসারে, প্রামানিকতা তার জন্য উত্থিত হয় একটি প্রকৃতি হিসেবে, সুনির্দিষ্ট হবার জন্য; যে প্রকৃতির তার নিজের মাঝেই একটি আলাদা অস্তিত্ব আছে। সংবেদনগত জগতের পরিবর্তনশীলতা, এর পরিবর্তন হিসেবে পরিবর্তন, নিজের মধ্যেই প্রতিভাসের প্রতিফলন- যা কালের ধারণা গঠন করে- এগুলোর আলাদা আলাদা অস্তিত্ব আছে ইন্দ্রিয়ের সচেতন সংবেদনশীলতার মধ্যে। মানব সংবেদন তাই কালের দেহী উপস্থাপন, যা সংবেদনগত জগতের নিজের মধ্যেই অস্তিত্বশীল প্রতিফলন।
ঠিক যেভাবে এটা এপিকিউরাসের মধ্যে কালের ধারণার সংঞ্চা হতে প্রত্যক্ষভাবে অনুসৃত, তেমনি করে এটা অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে প্রদর্শনও করা যাবে। হেরোডোটাসের প্রতি এপিকিউরাসের লেখা চিঠি হতে আমরা পাই কালের সংঞ্চা এরকম: কাল তখনই উত্থিত হয়, যখন দেহসমূহের ইন্দ্রিয়-অনুভূত আকস্মিকতাগুলোও আকস্মিকতা হিসেবে ভাবা হয়। সংবেদনগত প্রত্যক্ষণ নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত। সংবেদনগত প্রত্যক্ষণ এভাবে এখানে কালের উৎস, অথবা কাল স্বয়ং। যেহেতু উপমা কাল কে সংঞ্চায়িত করতে পারে না, এমনকি এর সম্পর্কে কোন কিছুই বলতে পারে না; কিন্তু এটাকে দৃঢ়ভাবে শক্তির সীমা পর্যন্ত রাখা প্রামাণিক। কারণ, নিজের মধ্যেই প্রতিফলিত সংবেদনগত প্রত্যক্ষণ হচ্ছে কাল নিজেই। একে জ্ঞঅতিক্রম করাঞ্চ বলে কিছুই নেই।
অন্যদিকে, লুক্রেটিয়াস, সেকটাস এম্পিরিকাস এবং স্টোবিউসে অবান্তর লক্ষণ, নিজের মধ্যে প্রতিফলিত পরিবর্তন কাল রূপে সংঞ্চায়িত। সংবেদনগত প্রত্যক্ষণে আকস্মিকতাগুলোর প্রতিফলন এবং তাদের নিজেদের মধ্যে নিজেদের প্রতিফলন সেখানে জ্ঞএকঞ্চ এবং জ্ঞঅভিন্নঞ্চ বলে মেনে নেয়া হয়। কাল ও সংবেদনতার মধ্যে আন্তঃসংযোগ এবং প্রতিরূপগুলো (যা ডেমোক্রিটাসেও সমানভাবে পাওয়া যায়) আরো সুসংহত মর্যাদা লাভ করে।
প্রতিরূপ হচ্ছে প্রাকৃতিক দেহের আঙ্গিক, যা উপরিতলের মতো, চামড়ার মতো বিচ্ছিন্ন; এবং তা এই দেহগুলোকে প্রতিভাসে স্থানান্তরিত করে। জিনিসগুলোর এই আঙ্গিকসমূহ তাদের থেকে বাইরের দিকে ধ্রুবভাবে প্রবাহিত হয় ও সংবেদনে প্রবেশ করে। আর মোদ্দা কথায়, এই পদ্ধতি বিষয়গুলোকে প্রতিভাসিত হতে দেয়। এভাবে শ্রবণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি নিজেকে শোনে, গন্ধ নেবার মধ্য দিয়ে সে নিজের গন্ধ নেয়, দেখার মধ্য দিয়ে সে নিজেকেই দেখে।* মানব সংবেদনই তাই সেই মাধ্যম, যার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো যেন একটি জ্ঞফোকাসেরঞ্চ মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত এবং প্রতিভাসের আলোকরশ্মির মধ্য দিয়ে প্রজ্জ্বলিত হয়।
ডেমোক্রিটাসে এটি একটি অসঙ্গতি- যেহেতু প্রতিভাস শুধুমাত্র বিষয়ীগত; আর এপিকিউরাসের মধ্যে এটি একটি প্রামাণিক ফলাফল- কারণ সংবেদন হচ্ছে প্রতিভাসের জগতে তার নিজের মধ্যেই প্রতিফলন এবং দেহীকৃত কাল।
শেষত: সংবেদনতা এবং কালের মধ্যকার আন্তঃসংযোগ এমন এক পদ্ধতিতে উন্মোচিত হয় যে, জিনিসের পার্থিব বৈশিষ্ট্য এবং ইন্দ্রিয়ে তাদের প্রতিভাসকে সহজাত জ্ঞঅভিন্নতাঞ্চ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যেন তারা জ্ঞগতঞ্চ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিরূপটি চিরন্তনভাবে তাদেরকে দেহগুলো হতে পৃথক করে; এবং অনুভূতিতে প্রবাহিত হয়ে, অন্য একটি প্রকৃতির মতো তাদের নিজেদের বাইরে সংবেদনশীল অস্তিত্ব নিয়ে, তাদের নিজেদের মাঝে ফিরে না আসার মধ্য দিয়ে এর মধ্য হতে মিলিয়ে যায়, চলে যায়।
তাই, পরমাণু যেমন অমূর্তের, স্বতন্ত্রের আত্ম-চৈতন্যের প্রাকৃতিক আঙ্গিক ছাড়া কিছুই নয়, তেমনি সংবেদনশীল প্রকৃতিই একমাত্র বিষয়কৃত, অভিঞ্চতামূলক, স্বতন্ত্র আত্ম-চৈতন্য; এবং এটাই হচ্ছে সংবেদন। এ কারণে অনুভূতিগুলো হচ্ছে নিরেট প্রকৃতিতে একমাত্র মানদন্ড; ঠিক যেমন, অমূর্ত বুদ্ধি হচ্ছে পরমাণুর জগতে একক মানদন্ড।

পরবর্তী অংশ