Marxists Internet Archive
Bangla Section


অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

সম্পাদকীয় পরিশিষ্ট: পারী পান্ডুলিপির প্রেক্ষাপট

রেনেসাঁর আমলের পরে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারী ছাড়া য়ুরোপের আর কোথাও এমন করে জগতগ্রাহ্য সাধু ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটেনি। সমগ্র য়ুরোপের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী যাদের আবর্জনা বলে খেদিয়ে দিচ্ছিল, সময় সাক্ষী, তারাই ছিল ইতিহাসের নুন। লুই ফিলিপের অপেক্ষাকৃত সহনশীল রাজত্বে তাঁদের আশ্রয় মিলছিলো। তিরিশ আর চল্লিশের দশকে বাকি য়ুরোপের প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকার হতে অন্য মানুষেরা একমাত্র আলোক শিখা পারীর দিকেই উড়ে আসছিল। এখানে বার্লিনের মত ঠুনকো জাতীয়তা নেই, লন্ডনের মত শীতল নিঃসঙ্গতা নেই, পারীর চারদিকে বরং উষ্ণ অভ্যর্থনা। একের সাথে অন্যের মত বাজিয়ে দেখার অনন্য সুযোগ। প্রবাসী সব বুদ্ধিজীবী একদিকে একমত। সবাই চার্চ আর সেনাবাহিনী, রাজা আর স্বৈরশাসক, পুরনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী অবস্থানে। সেই বিদ্রোহ প্রচন্ড আবেগের। চারদিকে মুক্ত চিন্তা, ভবিষ্যত পৃথিবী, মানবিক স্বপ্নের সমাজ গড়ার কল্পবাদী সৈনিকেরা রাশি রাশি বই লিখছে, সভা করছে, ষড়যন্ত্র করছে। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে আলোচনা, খোলামেলা তর্ক, পথে-ক্যাফেতে-ঘরে। সব মিলিয়ে চারদিকেই আশাব্যঞ্জক পরিবেশ।
বিপ্লবী লেখক আর র‌্যাডিকেল রাজনীতিবিদরা তখন তাদের ক্ষমতার তুঙ্গে। মানব মুক্তির স্বার্থে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়া এমন আন্তর্জাতিক সম্মিলন আগে কোথাও ঘটেনি। সবাই ভাবার সুযোগ পাচ্ছে যে তাদের কাজ মানবতার খাতিরে।
১৮৩০ সালের বিপ্লব প্রচেষ্টায় প্রতিক্রিয়াশীলতা এক দফা ধাক্কা খেয়েছে, তার ফল দিব্যি বিদ্যমান। ১৮৩৯ এর ব্লাঁকিপন্থী ষড়যন্ত্র রোমান্টিকরা সংকীর্ণ বলে প্রত্যাখ্যান করলেও তা আকস্মিক ছিল না। ঘটনার পেছনে ছিল চরম দূর্নীতিতে অকস্মাৎ শিল্প আর সম্পদের সমৃদ্ধি আবার তারপরেই সব দেউলিয়া হবার বাস্তবতা। সরকার নিয়ন্ত্রণ করছিল বড় মাপের পয়সাওয়ালা; রেল ব্যবসায়ী আর বৃহৎ শিল্পপতিরা। ব্যবসায়ী মারপ্যাঁচ আর ঘুষ, ফাটকা ব্যবসায়ীরা ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করছিল। শিল্প বিপ্লব দ্রুত নির্মমতার সাথে সব পাল্টে দিচ্ছিল। দক্ষিণ ফ্রান্সে ঘন ঘন শ্রমিক বিদ্রোহ। উদ্যমী, নিবেদিত প্রাণ যারা, তাদের কাছে সবই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। শিথিল, সহিষ্ণু সেন্সরশীপের এইকালের নায়কদের পাওয়া যায় বালজাক বা স্তাঁদালের লেখায়। তীক্ষ্ম রাজনৈতিক সাংবাদিকতা ছাপার অক্ষরের এত প্রভাব আগে দেখেনি। অসংখ্য জিনিয়াসে ঠাসা এই সমাজের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায়- মুসে, হেইন, দেলাক্রোয়া, তকভিল, ভাগনার, গতিয়ে, হার্জেন, তুর্গেনেভ, ভিক্তর উগো, জর্জ স্যান্ড, লিষ্ট্‌জ এর স্মৃতিকথা আর চিঠিতে। এই কাহিনী অনেকটাই আত্ম-বৈশ্লেষণিক, নাটকীয়। কিন্তু পুরনো শেকল ভাঙার উন্মাদনা আর নতুন সৃষ্টির ব্যাপ্ত সম্ভাবনায় তা মহৎ আর উদ্যমী।
মার্ক্স অবশ্য এই মহৎ অভিঞ্চতার খাতিরে পারীতে আসেন নি। পরিবেশ তাঁকে যতটা প্রভাবিত করে, তিনি ততটাই পরিবেশ তৈরী করার লোক। মুক্তি এলো বলে যে ভাব, অতি আগ্রহ হাইনে বা হার্জেনের ভাবনায় অস্থির, মার্ক্স তাতে আস্থা রাখেন নি। মার্ক্সের পারী আগমণের কারণ আরো ঠান্ডা মাথায় নেয়া। পারী তখন জার্মান-ফরাসি পঞ্জিকার মত পত্রিকা বের করার সবচাইতে ভালো জায়গা। তারচেয়ে বড় কথা- কিছু প্রশ্নের উত্তর তাঁর পেতে হবে, যা ফরাসি বিশ্বকোষ গোষ্ঠী, হেগেল বা ফয়েরবাখ কারোর কাছে পাওয়া যায়নি। ফরাসি বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ কি? বুদ্ধিবাদীরা তো বলতো বিঞ্চান, শিক্ষা, যুক্তি দিয়ে জগত পাল্টানো যায়, কিন্তু জাকোবীয় র‌্যাডিকেল দল ত্রাসের রাজত্ব দিয়ে বিপ্লব সফল করতে ব্যর্থ। হেগেল বলছেন মুক্তির দশায় পৌঁছনোর মত অবস্থায় তখনো দ্বন্দ্ব পেকে ওঠেনি। কিন্তু সময় পাকবার কোন লক্ষণবিদ্যাও তো তিনি দিয়ে যান নি। সেই বিদ্যা কি জানা যায়?
দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর আরো বেশি হাতে কলমের অভিঞ্চতা দাবী করে। নতুন শিল্প বিপ্লব; কলকারখানা, খনি, কৃষি, পরিবহনে প্রযুক্তি বিপ্লব জগতের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবন পাল্টে দিচ্ছে। তা যে একটা শ্রেণীকে ব্যাপক ধন সম্পদ আর আরেক শ্রেণীকে কল্পনাতীত দারিদ্র আর বিজাতীয়তা উপহার দিচ্ছে তা হেগেলও সিভিল সোসাইটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছেন। এই বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য, ফলাফল কি?
কার্ল মার্ক্সের ভাবনা পদ্ধতিতে অর্থনীতির গুরুত্ব ভালোভাবে পরিলক্ষিত হয় পারীতে চলে আসার কাল থেকেই। শিল্প বিপ্লবের মরতবা বুঝতে গিয়ে তিনি সহি জায়গাতেই তালিম নিতে গেলেন। এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো আর তাবৎ অর্থনৈতিক তাত্ত্বিকদের রচনা তিনি ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাঁর প্রথম গুরু হেগেলের কাছ থেকেই এই গুরুত্বের ছাপ তিনি পেয়েছিলেন। হেগেল সিভিল সমাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দক্ষভাবে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, সিভিল সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এমন এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী করে যেখানে প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ব্যক্তি স্বার্থ অন্যের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। সিভিল সমাজের অর্থনৈতিক কেরামতিতে হেগেল দেখিয়েছিলেন অহংবাদী বাসনার নিরবচ্ছিন্ন ঠোকাঠুকি। সম্পদ যে গুটি কয়েকের হাতে জমা হচ্ছে তার সুবাদেই ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের ভাবনা খুব জোর পেয়েছিল।
এদিকে ১৮৪৩ সালে মার্ক্সের খুব কাছের বন্ধু ব্রুনো বাউয়ের জার্মানীতে ইহুদীদের ক্রমবর্ধমান দূর্দশার সমাধান দিতে গিয়ে এক লেখা লেখেন। ইহুদীদের সমস্যাকে তিনি দেখলেন ধর্মতাত্ত্বিক পরিমন্ডল থেকে। রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিকভাবে ধর্ম আর রাষ্ট্রের সমস্যা পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। তাঁর প্রস্তাবনা হল- মানুষের মুক্তি মানে ধর্ম হতে মুক্তি। মার্ক্স ধর্মকে কোন স্বতন্ত্র ক্যাটেগরি হিসেবে মানতে নারাজ। তথাকথিত এই আত্মিক সমস্যা আসলে বাস্তব, জীবন্ত মানুষের বাস্তব, পার্থিব সমস্যা। পারী যাবার আগেই তিনি জ্ঞইহুদী প্রশ্নঞ্চ লেখায় ধর্মীয় সমস্যার মূলে দেখতে পেয়েছিলেন অর্থ নামে ঈশ্বরের প্রতাপ। ইহুদীদের সম্প্রদায়গত বাস্তবানুগতা, অহংবাদীতা তাদের ব্যাপক অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়েছে। গন্ডগোলটা বেঁধেছে সেখানেই। ব্যবসার বিজাতীয় জগতে অর্থনৈতিকভাবে বিজাতীয়তাপ্রাপ্ত মানুষকে মুক্ত করা যাবে কেবল একটা সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে- যে সমাজ বিপ্লব মানুষকে অর্থনৈতিক বিজাতীয়তা থেকে মুক্ত করবে, মানে তাদের যে সৃষ্টি তাদের কাছে বিজাতীয় হয়ে তাদের প্রভু হয়ে গেছে, মানুষ আবার তাদের উপর মালিকানা পাবে।
১৮৪৪ সালের জানুয়ারিতে এঙ্গেলসের লেখা জ্ঞরাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সমালোচনার রূপরেখাঞ্চ নামে লেখাটিও মার্ক্সের ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। যা হোক, বিপ্লবের ফলাফল মানব জীবনে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনছিলো তা বোঝার জন্য মার্ক্স অর্থনীতি তাত্ত্বিকদের রচনা অধ্যয়ন করতে লাগলেন। ১৮৪৪ এর শেষ নাগাদ তিনি ইংরেজ ও ফরাসি রাজনীতি ও অর্থনৈতিক তত্ত্বকে হজম করে ফেললেন। শুরু হল কোয়েসনে, এডাম স্মিথ হতে, থামলো সিঁসমাদি, রিকার্ডো, সে, প্রুঁধো আর তাদের শিষ্যদের রচনাতে। জার্মানদের দ্বিধাজড়িত আবেগি ধরণের তুলনায় এদের ঠান্ডা, চাঁচাছোলা ভাব, অভিঞ্চতামূলক অনুসন্ধানের উপর সাহসী জোর- এসব মার্ক্সকে তাঁর পদ্ধতির সাথে মিলিয়ে নিতে কাজে দিয়েছিল। ফরাসী সমাজতন্ত্রী আর ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের জোর হাওয়াতে হেগেলীয় রহস্যবাদের কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল। তবে একটা জায়গাতে খটকা রয়ে গেল। এসব তাত্ত্বিকদের রাজনৈতিক বাস্তবতার আঙ্গিকটা ভালো লাগলেও তাদের ঐতিহাসিক ঞ্চানের প্রয়োগ ও ধারণাগত ঘাটতি তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। এঙ্গেলস পরে বলেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এমন, যেন ক্রুসেডের কালে সিংহ হৃদয় রিচার্ডের আরেকটু অর্থনৈতিক ঞ্চান থাকলেই তিনি অযথা ক্রুসেড করে সময় নষ্ট না করে মুক্ত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করতেন, ছয়শো বছর হাতড়ে বেড়ানো থেকে বাঁচা যেত। প্রতিটি কালকে যে শুধুমাত্র ঐ কালের ধারণা এবং ক্যাটেগরি দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়, তা এই তাত্ত্বিকদের ধারণায় অপরিলক্ষিত। ফলে কল্পবাদীদের মনে হয়েছিল ব্যবস্থার মাঝ হতে শুধুমাত্র মন্দটুকুকে বাদ দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঐতিহাসিক গঠনের দৃষ্টিভঙ্গি যদি মার্ক্স পেয়ে থাকেন হেগেলের কাছ হতে, তাহলে ঐতিহাসিক গঠনের উপাদানগুলোর জন্য তিনি ঋণী সাঁ সিমো ও তাঁর শিষ্য, বিশেষ করে থিয়েরী ও মিনের কাছে। সাঁ সিমোঞ্চই প্রথম বলেছিলেন যে- অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিকাশই ইতিহাসে নির্ধারক উপাদান। তদুপরি তিনি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে অর্থনৈতিক শ্রেণীর নিরন্তর ঠোকাঠুকি হিসেবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। কোন বহাল শাসক শ্রেণীই জনসমষ্টির সর্বাধিক সম্পদকে নতুন সমাজ শর্তে যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করে না বা করতে চায়না। ফলে অবাধ্য প্রজা শ্রেণী ঐ স্বৈরশাসকদের ক্ষুদ্র শ্রেণীকে উৎখাত করতে এগোয়, কখনো সখনো সফলও হয়। কিন্তু দীর্ঘ দূর্ভোগের জীবন পরিক্রমায় নতুন শ্রেণীও তাদের পূর্বতন শাসকদের চাইতে উচ্চতর কোন ভাবাদর্শ ধারণ করতে পারে না। ফলে তাদের পদ্ধতিও হয় সমান বা আরো বেশি অযৌক্তিক। গড়ে ওঠে নতুন প্রতিরোধকারী- এগিয়ে চলে ইতিহাসের গতি। মানব ইতিহাস হল এমনই সব ঠোকাঠুকির ইতিহাস। এডাম স্মিথ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিকেরা যেমন করে বলেন, এর কারণ হল- হুজুর এবং মজুর, উভয় শ্রেণীর অর্থনৈতিক সম্পদের যৌক্তিক বন্টনের মাধ্যমে তাদের স্বার্থের সমাপতনের ব্যাপারে তাদের অন্ধত্ব। সাঁ সিমো মানব প্রগতিকে দেখেছেন সমাজের মাঝে মানুষের উদ্ভাবনী ক্রিয়া হিসেবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর চলতি ধারণার মতো তিনি মানব প্রকৃতিকে আঁটসাট, বদ্ধ বলে মনে করতেন না। তবে তিনি এটা মনে করতেন যে, কোন নির্দিষ্ট কালের প্রকৃত অভাবে সাড়া দেয়া সমাজ ব্যবস্থা পরবর্তীকালের সমাজ সঞ্চালনের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। য়ুরোপের মধ্যযুগে প্রগতিশীল শক্তি চার্চ বা সৈন্যদল এখন অকেজো। তার কাজ সারছে ব্যাংকার, বিঞ্চানী, শিল্পপতিরা; তারা এখন শুধু পরজীবী, তাই তাদের দূর করা প্রয়োজন। সাঁ সিমোবাদীরা এও মনে করতেন যে, সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন রদ্‌ করা উচিত। যাতে জন্মসূত্রে মানুষ সম্পদগত বৈষম্যের শিকার না হয়। তবে ব্যক্তি সম্পত্তি থাকবে, কারণ তা ব্যক্তি শ্রমের তুষ্টির চূড়ান্ত প্রকাশ, সব নৈতিকতার ভিত্তি। সাঁ সিমোর জীবৎকালে পশ্চিম য়ুরোপে সামন্তবাদে শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলোও বুর্জোয়াদের অগ্রাভিযানে উড়ে যাচ্ছিল। প্রযুক্তির ক্ষমতা ও মানব সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারে তাঁর ছিল অটুট বিশ্বাস। স্বার্থপর ভূ-অধিকারীদের তুলনায় নবোদিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাঁর মনে হচ্ছিল যথার্থ পরার্থবাদী, উদ্যমী, যৌক্তিক, উদীয়মান বুর্জোয়াদের যথার্থ মুরুব্বী সাঁ সিমো যন্ত্র প্রযুক্তি, বড় মাপের শিল্প পরিকল্পনাকে উঁচু মূল্য দিয়েছেন। তবে এই তিনিই শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের প্রথম মৌলিক রূপকার।
সাঁ সিমোর সবচাইতে কদরদান ভাবাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন ব্যবসায়ী পরিব্রাজক শার্ল ফুরিয়ে। লগ্নি পুঁজিওয়ালা আর শিল্পপতিদের ওপরে সাঁ সিমোর অগাধ ভরসা ছিল। ফরাসি দেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তারা অর্থ ব্যবস্থাপনা আর শ্রম নিযুক্তিতে পুরোপুরি দখল নিয়ে ব্যাপক উৎপাদন আর বন্টনের সম্ভাবনা তৈরী করেছিল। পুঁজির স্বভাব অনুযায়ীই খুদে বণিকদের, অসম শর্তে খোলা বাজার হতে ঝাঁটিয়ে বিদায় করে তাদের ছেলেপিলেদের নিজেদের কারখানা, খনিতে কাজে লাগালো বড় শিল্প। ফরাসি দেশে শিল্প বিপ্লব বড় আর খুদে বুর্জোয়াদের মাঝে তিক্ত ফাটল সৃষ্টি করলো। সর্বস্বান্ত খুদে বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি ফুরিয়ে অস্বীকার করলেন যে, পুঁজিপতিরাই সমাজের পূর্বনির্ধারিত পরিত্রাতা। তাঁর সমকালীন সুইস্‌ অর্থনীতিবিদ সিসমঁদি একজন জিনিয়াসের মত, ঐ কালেই ঐতিহাসিক প্রমাণ সহ দেখান যে- আগের সব শ্রেণী সংগ্রাম হয়েছে সম্পদের ঘাটতির কারণে, আর এখন নতুন প্রযুক্তি পৃথিবীতে সম্পদ তথা পণ্যের সয়লাব বইয়ে দেবে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লেগে থাকা পুঁজিপতিরা পণ্যের বাজারে এগিয়ে থাকতে গিয়ে ক্রমবর্ধমান মজুরী কমাবে, কর্মঘন্টা বাড়াবে। ফলে হালকা চালে চলা প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় এগিয়ে থাকা যাবে। এতে আবার ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দেবে, বিভিন্ন পুঁজিপতি গ্রুপের লড়াইয়ের বদৌলতে। তা শেষ হবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায়। পণ্যের উৎপাদনের সমান তালে বাড়ছে কৃত্রিম দারিদ্র, ফরাসী বিপ্লব যে মানবিক চাহিদা পূরণের দাবি তুলেছিল তার মাটিতে গড়াগড়ি যাওয়া রূপ দেখে সিসমঁদি সুপারিশ করলেন রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের। রাষ্ট্রকে অবশ্যই পুঁজির ভয়াবহ রকমের জমা হওয়াকে সীমিত আকারে বেঁধে রাখতে হবে, উৎপাদনের মাধ্যমগুলোকে মোটামুটি রকম নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। শার্ল ফুরিয়ে তাঁর প্রস্তাবনার বিরোধিতা করলেন। তিনি কোন রকম কেন্দ্রীয় আধিপত্য মানতে নারাজ। তার মতে, সরকারের ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রনের একক এত বড় আকারের হলে সেখানে আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাসন উদ্ভূত হতে বাধ্য। তাঁর মতে পৃথিবীকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দেয়া উচিত। তিনি এগুলোর নাম দিলেন ফ্যালানসস্টেরি। এর অন্তর্গত ভূমি, যন্ত্রপাতির মালিকানা থাকবে সাধারণের। প্রত্যেকটা গ্রুপ আত্ম-নিয়ন্ত্রিতভাবে, শাসিত হয়ে ক্রমাগত বড় আঙ্গিকে অন্যান্য গ্রুপের সাথে ফেডারেশন গড়ে তুলবে। অর্থলগ্নিকারী, তাদের ভাড়াটে বিচারক, সৈন্য, প্রশাসকদের হাতে স্বতন্ত্র মানুষ, তার সম্ভাবনাঞ্চর পায়ে দলে যাওয়ার পদ্ধতির (যাকে কেতাবী ভাষায় কতভড়ড়ন।-পতভক্ষন বলা হয়) বিরুদ্ধে ফুরিয়ের প্রস্তাবনা ছিল এক বিদ্রোহ।
১৮৩০ এর বিপ্লবে ফ্রান্সে দশম শার্ল গদি হারালেন। সমাজ প্রশ্নে গণ-স্বার্থ ব্যাপক জোর পেল। বহাল প্রাতিষ্ঠানিক নষ্টামীর বিরুদ্ধে স্রোতের মত বইপত্র, মতামত বইতে লাগলো। সব ধরণের আপোষ-রফা ধিকৃত হয়ে গেল। লা মার্তিন দিলেন হালকা উদারবাদী পরামর্শ, লেদ্রু রোলা প্রস্তাব করলেন আধা-সমাজতন্ত্রী র‌্যাডিকেল প্রস্তাব আর তা লুই ব্লাঞ্চর বিকশিত রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র হয়ে শেষমেষ পৌঁছলো বার্বে এবং ব্লাকিঁঞ্চর ব্যক্তি সম্পত্তি উৎখাত ও সশস্ত্র বিপ্লবের ডাকে। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ মধ্যে ফুরিয়েঞ্চর শিষ্য কনসিদেরা; লুই ব্লাঁ, আর তাদের মাঝে সবচেয়ে মৌলিক প্রুধোঁঞ্চর বইগুলো ছেপে বেরোতে লাগলো। ১৮৩৪ সালে খৃষ্টান সমাজতন্ত্রী, ক্যাথলিক সাধু লামেনাই বের করলেন জ্ঞজ্ঞএকজন বিশ্বাসীঞ্চর বচনঞ্চঞ্চ, ১৮৪০ সালে ছাপলো এবে কনস্তাঁঞ্চর জ্ঞজ্ঞমুক্তির বাইবেলঞ্চঞ্চ। এমন কি চার্চের ভেতরেও সমাজতন্ত্রী জন্মাতে লাগলো। ক্যাবে লিখলেন তাঁর ধ্রুপদী রচনা জ্ঞআইকেরিয়ায় ভ্রমণঞ্চ।
এই বিশাল আলোড়নের তাৎক্ষণিক ফলাফল ছিল অদ্ভুত। সাঁ সিমোঞ্চপন্থীরা অল্প সময়েই বিরল হয়ে উঠলেন, তাদের কেউ কেউ বড় রেল ব্যবসায়ী হলেন। ফুরিয়ে অনুসারীরা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কমিউনিস্ট বসতি গড়ে তুললেন। আঠারোশো ষাটের দশকে তাঁরা ঞ্চগনংঢষক্ষয ঝক্ষভথয়শনঞ্চ পত্রিকার মাধ্যমে আমেরিকার তাবত বুদ্ধিজীবীদের বেশ আকৃষ্ট করেছিলেন।
সব মিলিয়ে যত ধরণের মত,পথ, আদর্শ ছিল তারা যার যার পরিনতিতে পৌঁছে থিতু হয়ে বসে ছিল। এই সময়টাই ছিল বিশাল চিন্তাসমুদ্র মন্থনের ভাল সময়। তরুন মার্ক্স সে সুযোগ নষ্ট করেন নি। তার ফল হিসেবে আমাদের হাতে পৌছে ১৮৪৪ এর অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া।

পরবর্তী অংশ