Marxists Internet Archive
Bangla Section


অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

দ্বিতীয় পান্ডুলিপি: পূঁজি ও শ্রমের এন্টিথিসিস। ভূ-সম্পত্তি ও পূঁজি

[.......] তার পুঁজির স্বার্থ গঠন করে।(ত) শ্রমিক এই সত্যতার বিষয়ীগত প্রকাশ যে- পুঁজি হচ্ছে সেই মানুষ যে নিজের মধ্যে সামগ্রিকভাবে বিলীন। ঠিক যেমন পুঁজি হচ্ছে এই সত্যতার বিষয়গত প্রকাশ যে শ্রম হচ্ছে সেই মানুষ যে নিজের মধ্যে বিলীন। শ্রমিকদেরকে জীবন্ত পুঁজি হওয়ার দূভার্গ্য পোহাতে হয়; সে একটা হতদরিদ্র পুঁজি যে তার স্বার্থ হারিয়েছে আর তাই হারিয়েছে জীবিকা। যে মুহূর্তেই সে খাটছে না, তখনই সে জীবিকা বঞ্চিত। পুঁজি হিসেবে শ্রমিকের মূল্য চাহিদা এবং যোগান অনুসারে বাড়ে কমে আর শারীরিকভাবেও তার অস্তিত্ব, তার জীবনকে অন্যসব পণ্যের মত দেখে আসা হচ্ছে, হয়েছে। শ্রমিক পুঁজি উৎপাদন করে, পুঁজি তাকে উৎপাদন করে- তাই সে নিজেকেই উৎপাদন করে। আর শ্রমিক হিসেবে একটা পণ্য হিসেবে মানুষ তার সমগ্র চক্রের উৎপাদন বিশেষ। যে মানুষ একজন শ্রমিকের চাইতে বেশি কিছু নয় তার কাছে- আর একজন শ্রমিক হিসেবে তার নিজের কাছে তার মানবিক গুণাবলী কেবল ততদূর পর্যন্তই অস্তিত্বমান, যতদূর পর্যন্ত সে তার কাছে বিজাতীয় পুঁজির স্বার্থে অস্তিত্বমান। কারণ মানুষ এবং পুঁজি একে অপরের প্রতি বিজাতীয়, অচেনা। যা হোক, এমনি করে তারা অবস্থান নেয় একে অপরের প্রতি একটা অবিচ্ছেদ্দ, বাহ্যিক এবং আকস্মিক সম্পর্কে। এই অচেনাপনাও যে বাস্তব কিছু একটা হিসেবে প্রতিভাত হবে তাও অনিবার্য। যখনই পুঁজির ক্ষেত্রে এটা ঘটে (প্রয়োজন বা খেয়ালের বশেই হোক), তা আর শ্রমিকের জন্য থাকেনা বলে সে নিজেও আর নিজের জন্য থাকে না : তার কোন কাজ নেই, তাই কোন মজুরীও নেই। আর যেহেতু মানুষ মানবসত্তা হিসেবে তার কোন অস্তিত্ব নেই, অস্তিত্ব আছে কেবল একজন শ্রমিক হিসেবে, সে তখন নিজের কবর খুঁড়ে নিজেকে পুঁতে ফেলতে পারে, অনাহারে মরেও যেতে পারে, ইত্যাদি। শ্রমিক ততক্ষণই কেবল শ্রমিক হিসেবে অস্তিত্বশীল, যতক্ষণ সে নিজের জন্যই পুঁজি হিসেবে অস্তিত্বশীল; আর শুধুমাত্র তখনই সে পুঁজি হিসেবে অস্তিত্বশীল যখন তার জন্য কিছু পুঁজি অস্তিত্বশীল। পুঁজির অস্তিত্বই তার অস্তিত্ব, তার জীবন; পুঁজি তার নিজের সাথে অভিন্নভাবে শ্রমিকের জীবনের তাৎপর্য নির্ধারণ করে।
তাই রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে বেকার, খেটে খাওয়া মানুষের কোন মানেই নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এই শ্রম সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করছে। বদমাশ, ঠকবাজ, ভিখারী, বেকার, উপোসী, হতভাগ্য আর অপরাধী মজদুর- এরা রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের চোখেই পড়েনা; চোখে পড়ে ডাক্তার, বিচারক, গোরখোদক, অকর্মা প্রশাসকের। এরকম সব শরীরগুলো রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের রাজত্বের বাইরে ঘুরে বেড়ানো ভূত-পেত্নী। এই কারণে শ্রমিকদের প্রয়োজনটি এমন এক প্রয়োজন- যার মানে হলো যতক্ষণ সে কাজ করছে ততক্ষণ তাকে বাঁচিয়ে রাখা আর প্রয়োজন হলে শ্রমিকদের জাতটাকে [মরে] সাফ হয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। এমনি করে শ্রমের মজুরীও অন্য যেকোন উৎপাদনের হাতিয়ার অথবা সাধারণভাবে পুঁজির ভোগের মতোই রক্ষণাবেক্ষণ এবং ঠিকঠাক রাখার তাৎপর্য বহন করে। যেমন করে চাকাটাকে চালু রাখতে হলে তেল দিতে হয়, সে তেলের মতই মজুরীটাও প্রয়োজন লাভের সাথে পুঁজির পুনরুৎপাদনের জন্য। তাই মজুরী হল পুঁজি এবং পুঁজিপতির দরকারী খরচ, যা কোনমতেই এই দরকারের সীমা অতিক্রম করবে না। তাই ১৮৩৪ এর সংশোধনী বিলের আগে ইংরেজ কারখানা মালিকেরা যৌক্তিকভাবেই জনস্বার্থে দানের জন্য হিসেবটা শ্রমিকদের মজুরী থেকেই কেটে নিত, এটা আবার তারা দারিদ্র হারের হিসেবে গ্রহণ করত আর একে মজুরীর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করত।(৭)
উৎপাদন মানুষকে কেবল একটা পণ্য মানে মানব পণ্য হিসেবেই উৎপন্ন করে না, মানুষ এখানে শুধু পণ্যের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয় না। উৎপাদন তাকে এমন করে উৎপাদন করে যে সে এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে মানসিক এবং শারীরিকভাবে অমানবিক সত্তায় পরিণত হয়। - এ হল শ্রমিক এবং পুঁজিপতির একঘেয়ে হওয়া অমরতা, তালগোল পাকিয়ে যাওয়া। এর উৎপাদন হলো আত্মচেতন এবং আত্ম ক্রিয়াশীল পণ্য......মানব পণ্য......। স্মিথ এবং সে* এর উপরে রিকার্ডো, মিল, অন্যান্যদের একটা বড় অগ্রগতি আছে। অগ্রগতিটা হলো মানবসত্তার অস্তিত্বকে ঘোষণা করা- পণ্যের বৃহত্তর অথবা ক্ষুদ্রতর মানব উৎপাদনশীলতাকে- অবিচ্ছেদ্য আর এমনকি ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করা। প্রদত্ত পুঁজি দিয়ে কত শ্রমিক প্রতিপালিত হচ্ছে তার বদলে বরং এই পুঁজি কতটা মুনাফা আনছে, বার্ষিক সঞ্চয়ের মোট পরিমাণটা কত তাকেই বলা হয়ে থাকে উৎপাদনের আসল উদ্দেশ্য।
একইরকম ভাবে আধুনিক ইংরেজ অর্থশাস্ত্রীদের একটা বড় এবং সুস্থিত অগ্রগতি ছিল। শ্রমকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের একক নীতিতে উত্তরিত করতে গিয়ে একে একই সময়ে মজুরী এবং পুঁজির উপর লভ্যাংশের উল্টো সম্পর্কটা, আর পুঁজিপতি যে সাধারণত কেবল মজুরীর উপর চাপ দিয়েই লাভ করতে পারে এবং এর উল্টোটা, এই সত্যগুলো একেবারে স্বচ্ছভাবে স্পষ্ট করে দিতে হয়েছে। শুধু ভোক্তাকে ঠকানো নয়- পুঁজিপতি এবং শ্রমিকের একে অপরের সঙ্গে চালাকি করে যাওয়াই সাধারণ সম্পর্ক বলে দেখাতে হয়।
ব্যক্তি সম্পত্তির সম্পর্কগুলো তাদের নিজেদের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় কিছু সম্পর্ক ধারণ করে। সম্পর্কগুলো হচ্ছে শ্রম হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি, পুঁজি হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি এবং এই দুটোর একে অপরের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক। সেখানে মানব ক্রিয়ার উৎপাদন হিসেবে সে নিজের কাছে একেবারেই বিজাতীয়। আর তাই তা চৈতন্য এবং জীবন প্রকাশের কাছেও বিজাতীয়। ফলে মানুষের অমূর্ত অস্তিত্ব নিছক একজন খেটে খাওয়া মানুষ হিসেবে। ফলে সেই শ্রমিক প্রতিদিন পূর্ণ শূন্যতা হতে পরম শূন্যতায় যায়। এমনি করে চলে যায় সামাজিক আর তাই বাস্তব অনস্তিত্বে। অপরদিকে রয়েছে পুঁজি হিসেবে মানব ক্রিয়ার বিষয়ের উৎপাদন। এতে বিষয়ের সমস্ত স্বাভাবিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্বাপিত হয়ে যায়। এতে ব্যক্তি সম্পত্তি তার স্বাভাবিক এবং সামাজিক গুণ হারিয়ে ফেলেছে (আর তাই সে হারিয়েছে প্রতিটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক মায়া, কোন প্রতীয়মান মানব সম্পর্কের সঙ্গেই সে যুক্ত নয়)। এতে সেই একই রকমের পুঁজি সবচাইতে বৈচিত্র্যময় স্বাভাবিক এবং সামাজিক প্রদর্শনেও একই রয়ে যায়, এর বাস্তব আধেয়ঞ্চর সঙ্গে একেবারেই অবিচ্ছিন্ন। এই পরস্পর বিরোধীতাকে চূড়ান্ত সীমার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেলে প্রামাণিক সীমার চূড়ান্ত বিন্দুতে তার মানেই হবে সমগ্র ব্যক্তি সম্পত্তির সম্পর্কের ধ্বস এবং বিনাশ।
আর তাই জমির খাজনাকে কর্ষণাধীন সবচাইতে ভালো আর সবচাইতে খারাপ জমির রোজগারের পার্থক্য হিসেবে ঘোষণা করাটা আধুনিক ইংরেজ অর্থশাস্ত্রের একটা বড় অজর্ন। এ অর্জনের মধ্যে আরো যা আছে তা হলো জমি মালিকের রোমান্টিক মায়াটাকে- তার বৈধ সামাজিক গুরুত্ব এবং তার স্বার্থের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থের মায়াটাকে উন্মোচন করে দেয়া। এডাম স্মিথ ফিজিওক্রেটদের অনুসারে এখনো এই মত মানেন। আধুনিক ইংরেজ রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীরা বাস্তব জগতের সঞ্ঝালনটিকে আগেই দেখে ফেলে প্রস্তুত করেছেন। এই সঞ্চালনটি জমি মালিককে একজন সাধারণ সাবেককালের পুঁজিপতি বানিয়ে ফেলবে আর এভাবে দ্বন্দ্বটি (পুঁজি এবং শ্রমের) সরলীকৃত এবং তীক্ষ্ম হবে এবং এর সমাধানও ত্বরান্বিত হবে। জমি হিসেবে জমি এবং খাজনা হিসেবে খাজনা পদমর্যাদার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বৈশিষ্ট্যহীন পুঁজি এবং রোজগারে অথবা এমন পুঁজি এবং রোজগারে পরিণত হয়েছে যা অর্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না।
পুঁজি এবং ভূমির মধ্যে, মুনাফা এবং খাজনার মধ্যে, এই দুটো এবং মজুরীর মধ্যের পার্থক্যগুলো জিনিসের স্বভাবের মধ্যেই নিহিত নেই। এগুলো একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত ও ক্ষণ। শিল্প, ইত্যাদিতে ভূ-গত সম্পত্তি হিসেবে তা প্রকাশিত হয় কেবল সেই পথে যাতে এটি (শিল্প) অস্তিত্বশীল হয়েছে আর কৃষির সঙ্গে সেই দ্বন্দ্বে যাতে শিল্প বিকশিত হয়েছে। এই পার্থক্য কেবল একটি বিশেষ ধরণের কাজ- একটি প্রামাণিক গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন বেষ্টনকারী পার্থক্য হিসেবেই অস্তিত্বশীলতা চলমান রাখতে পারে- যতক্ষণ পর্যন্ত শিল্প (শহর জীবন) ভূমিগত সম্পত্তির (অভিজাত সামন্তীয় জীবন) উপর এরই বিরুদ্ধে বিকশিত হয় এবং নিজেই মনোপলি, কারুশিল্প, গিল্ড, কর্পোরেশন ইত্যাদির আঙ্গিকে এর বিপরীতটির সামন্তীয় চরিত্র বহন করতে থাকে। এই আঙ্গিকগুলোর ভেতরে শ্রমের এখনো একটা প্রতীয়মান সামাজিক বৈশিষ্ট্য আছে, এখনো বাস্তব সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যটি আছে। এগুলো এখনো এর আধেয়র সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন তথা সম্পূর্ণ সত্তার জন্য অস্তিত্বে পৌঁছয় নি।(৮) সত্তার জন্য অস্তিত্বের মানে বাকি সব সত্তা হতে অমূর্তায়ন, এর ফলেই এগুলো কখনো মুক্ত পুঁজিতে পরিণত হয়নি।
কিন্তু মুক্তিপ্রাপ্ত শিল্প, শিল্পের জন্য গঠিত শিল্প যেমন হয়, মুক্তিপ্রাপ্ত পুঁজি হলো শ্রমের প্রামাণিক বিকাশ। প্রতিপক্ষের উপর শিল্পের ক্ষমতা বাস্তব শিল্প হিসেবে কৃষির উত্থানের মাঝে সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হয়ে পড়লো, যেখানে আগে কৃষি অধিকাংশ কাজই জমি এবং জমির দাসদের ওপর ছেড়ে দিত, যাদের মাধ্যমে ভূমি নিজেকেই চাষ করত। দাসদের মুক্ত শ্রমিক অর্থাৎ ভাড়াটে শ্রমিকে রূপান্তরিত করার মাঝ দিয়ে- ভূ-স্বামী নিজেই শিল্পের অধিপতি একজন পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হলেন। এর রূপান্তরটি প্রথমে সাধিত হয়েছিল ভাগচাষীদের মধ্যস্ততায়। তবে যা-ই হোক, ভাগচাষী হচ্ছে জমি মালিকের প্রতিনিধি- তার ফাঁস হয়ে যাওয়া গোপনীয়তা। ভাগচাষীর মাধ্যমেই কেবল জমি মালিকের অর্থনৈতিক অস্তিত্ব মানে ব্যক্তি সম্পত্তিওয়ালা হিসেবে অস্তিত্বটি টিকে থাকে- কারণ তার জমির খাজনা বহাল থাকে কেবল চাষীদের মাঝখানে প্রতিযোগিতার ফলে।
এভাবে ভাগচাষী-ব্যক্তির মধ্যে ইতিমধ্যেই জমির মালিক সারসত্তায় একজন সাধারণ পুঁজিপতিতে পরিণত হয়েছেন। আর বাস্তবে এটাও ঘটতে হবে যে : পুঁজিপতি (কৃষিতে ব্যস্ত ভাগচাষী)- অবশ্যই একজন জমি মালিক হয়ে উঠবে অথবা এর উল্টোটা। ভাগচাষীর শিল্প ফেরিওয়ালাগিরি হলো ভূ-স্বামীর শিল্প ফেরিওয়ালাগিরি, কারণ আগের জনের সত্তা পরের জনের সত্তা স্বতঃসিদ্ধায়িত করছে।
কিন্তু পুঁজিপতির এই উল্টোরকম উৎপত্তি আর তাদের জন্মপঞ্জির কথা মনে রেখে ভূস্বামী পুঁজিপতিদেরকে বিবেচনা করে উদ্ধত, মুক্তিপ্রাপ্ত, গতকালকের দাস হিসেবে আর নিজেকে দেখে এমন একজন পুঁজিপতি হিসেবে যে কিনা তার দ্বারা হুমকিপ্রাপ্ত। আবার পুঁজিপতি ভূস্বামীকে জানে তার বিগত দিনের অকর্মণ্য, নিষ্ঠুর, আত্মগর্বী প্রভু হিসেবে; সে জানে যে পুঁজিপতি হিসেবে সে তাকে আহত করছে, তবে বর্তমানের সব সামাজিক মর্যাদা, তার সম্পত্তি তার ফুর্তির জন্য সে শিল্পের কাছে কৃতঞ্চ। সে ভূস্বামীর মাঝে মুক্ত শিল্প এবং মুক্ত পুঁজির (সব স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতা থেকে স্বাধীন পুঁজির) একটা দ্বন্দ্ব দেখতে পায়। এই দ্বন্দ্ব (ভূস্বামী এবং পুঁজিপতির মাঝে) খুবই তিক্ত আর প্রত্যেক পক্ষই অপরপক্ষের আসল সত্যটা ফাঁস করে দেয়। স্থাবরের ওপর অস্থাবর এবং অস্থাবরের ওপর স্থাবর সম্পত্তির আক্রমণগুলো খেয়াল করলেই তাদের পারস্পরিক অথর্বতাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ভূস্বামী জোর দেয় তার সম্পত্তির অভিজাত বংশক্রম, সামন্তযুগীয় স্মৃতিচিহ্ন, অনুসৃতি, পুরনো দিনের কাব্য, তার সম্পত্তির রোমান্টিক বেহাত হওয়া, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব এই সবের ওপর। অর্থনীতির কথায় সে কেবল কৃষিকেই উৎপাদনশীল মনে করে। একই কালে সে তার প্রতিপক্ষকে ধূর্ত বাজপাখীর মত ছিদ্রান্বেষী, ঠকবাজ, লোভী. অর্থগৃধ্ন, ভাড়াটে, বিদ্রোহী, হৃদয়হীন ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে, যে কিনা সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তা নিয়ে মুক্তভাবে ব্যবসা চালায়। যে কিনা প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়, লালন পালন করে আর এর সাথে লালন করে কপর্দকহীনতা অপরাধ এবং সবরকমের সামাজিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ। ভূস্বামীর কাছে পুঁজিপতি হলো দালাল, বংশবদ, নির্ঝঞ্ঝাট, চাটুকার, ধাপ্পাবাজ, বদমাশ- যার সম্মান, নীতি, কাব্য, সারবস্তু- সোজা কথায় কিছুই নেই (অন্যান্যদের সঙ্গে ফিজিওক্রেট বার্গেস দেখুন- যাকে ক্যামিল দেস মঁ লি তার জার্নালে গালাগাল করেছেন,(৯) দেখুন ভন ভিংকে, লে সি জল, হেলার, লিও, কোস গার্তেন এবং একই সাথে সিসমঁদি)।
স্থাবর সম্পত্তি এর দিক থেকে শিল্প ও উন্নয়নের অলৌকিকতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এটা আধুনিক কালের শিশু- তার বৈধ, স্বদেশ জাত শিশু। এটা তার প্রতিপক্ষদের করুণা করে নির্বোধ, তার নিজের প্রকৃতি সম্পর্কে অনালোকিত বলে (আর এক্ষেত্রে এটা একদম ঠিক), যে কিনা নৈতিক পুঁজি এবং মুক্ত শ্রমকে পুনঃস্থাপিত করতে চায় পাশবিক, নীতিহীন সহিংসতা এবং ভূমিদাস প্রথার মাধ্যমে। এটা তাকে ডন কুইক্সোট হিসেবে চিহ্নিত করে- যে তার স্থূলবুদ্ধি, গুরুদায়িত্ব, জনস্বার্থ, স্থিতিশীলতার আড়ালে তার উন্নতির অক্ষমতা, লোভী স্ব-পরিতোষণ, স্বার্থপরতা, গোষ্ঠস্বার্থ ও কু-অভিপ্রায়সমূহ গোপন করে। সে তাকে ঘোষণা করে একজন শিল্পসম্মত মনোপলিস্ট রূপে; এটা তার পূর্বস্মৃতির ক্ষতে, তার কাব্য জগতে, তার রোমান্টিসিজমে শীতল জল ঢালে। আর তা হয়ে থাকে ভিত্তিগততার নিষ্ঠুরতা, অধোপতনতা, বারবধুতা, কলঙ্কময়তা, নৈরাজ্য এবং বিদ্রোহত্বের এক ঐতিহাসিক এবং শ্লেষাত্মক তালিকা দ্বারা, যার রোমান্টিক দূর্গগুলো ছিল কর্মশালা।
এটা প্রত্যেকের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের, সিভিল সমাজকে বেঁধে রাখা শেকলগুলো আলগা করে দেয়া ভিন্ন জগতগুলোকে সেতুবদ্ধ করার, জনগণের মাঝে ব্যবসা বাণিজ্যের উসিলায় বন্ধুত্ব তৈরী করার; শুদ্ধ নৈতিকতা এবং মনোঞ্চ সংস্কৃতি সৃষ্টি করার; জনগণের স্থুল অভাবের বদলে সভ্য প্রয়োজন দেবার এবং ঐ প্রয়োজনগুলো পরিতৃপ্তির মাধ্যম দেবার দাবি করে। ইতিমধ্যে সে এও দাবি করে যে অলস, পরজীবী, শস্যমুনাফাখোর ভূস্বামী জনগণের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে পুঁজিপতিরা বাধ্য হচ্ছে উৎপাদনশীলতা না বাড়িয়েই মজুরী বাড়াতে। আর এমনি করে ব্যহত হচ্ছে জাতির বার্ষিক আয় (প্রবৃদ্ধি), পুঁজির পুঞ্জিভবন, আর তাই জনগণকে কাজ এবং দেশকে সম্পদ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এমনি করে একটা সাধারণ ক্ষয় উৎপাদিত হয়, আর এসব বলে পুঁজিপতি পরজীবীর মত আধুনিক সভ্যতার সমস্ত সুযোগগুলো ব্যবহার করে সভ্যতার জন্য কিছুই না করে, এমনকি তার সামন্তীয় সংস্কার থেকেও তিলমাত্র সরে আসে না। শেষে যার কাছে জমির চাষ এবং খোদ জমি কেবলমাত্র অর্থের উৎস, যে জমি আবার সে পেয়েছে উপহার হিসেবে- সে একবার তাকাক তার ভাগচাষীদের দিকে আর বলুক সে নিজেই কি একটা দস্তুর মত ঠগ, বদমাশ নয় যার হৃদয় এবং বাস্তব কাজ অনেক আগে থেকেই মুক্ত শিল্প এবং মোহনীয় ব্যবসার এখতিয়ারে পড়ে আছে, সে যতই ঐতিহাসিক স্মৃতি আর নৈতিক বা রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে ওজর আপত্তি তুলুক, যতই বাজে বক্‌বক্‌ করুক। নিজেকে যথার্থ প্রতিপন্ন করার জন্য সে যাই করুক, তা সত্য কেবল জমি কর্ষণকারীদের ওপরে, (পুঁজিপতি এবং মজদুর) ভূস্বামী যাদের কেবলই শত্রু মাত্র। এভাবে সে নিজেরই বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দেয়। (অস্থাবর সম্পত্তি দাবী করে যে) পুঁজি ছাড়া ভূগত সম্পত্তি মৃত, অকেজো এক জিনিস; তার আরো দাবি যে তার সভ্যচিত বিজয় মানব শ্রমকে আবিষ্কার করে মৃত জিনিসের বদলে সম্পদের উৎস হিসেবে স্থান দিয়েছে। (দেখুন পল লুই কুরিয়ে, সাঁ সিমো, গ্যানিল, রিকার্ডো, মিল, ম্যাককুলক, দ্য ত্রেসি এবং মিশে শেভেলিয়ে)(১০)
বিকাশের বাস্তব স্তরক্রম (এই বিন্দুতে সন্নিবিষ্ট করতে হবে) ভূস্বামীদের ওপর পুঁজিপতিদের প্রামাণিক বিজয়ে ফল লাভ করে। তার মানে অবিকশিতঞ্চর ওপর বিকশিতঞ্চর বিজয়- ঠিক যেমন সাধারণভাবে গতি জয় লাভ করে গতিহীনের ওপর; খোলামেলা, আত্ম-চৈতন্য ভিত্তিময়তা জিতে যায় গোপন, অচেতন ভিত্তিময়তার ওপর; যেমন আত্ম-তোষণকে পরাজিত করে সৌন্দর্যবৃত্তি; যেমন ঘোষিত বিরামহীনতা আলোকায়নের দক্ষ আত্ম-স্বার্থ জিতে যায় সংকীর্ণ, বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন, সম্মানিত, অলস আর কল্পনা বিহারী কুসংস্কারের আত্ম-স্বার্থের ওপর; আর অর্থ যেভাবে বিজয়ী হয় ব্যক্তি সম্পত্তির অন্যান্য আঙ্গিকের ওপর।
পূর্ণ বিকশিত মুক্ত শিল্পের সাথে, পূর্ণ বিকশিত শুদ্ধ নৈতিকতার সাথে, আর পূর্ণ বিকশিত মানব হিতৈষী বাণিজ্যের সাথে জড়ানো বিপদগুলোর দৈব কোন এক দশা চেষ্টা চালিয়ে গেল, কিন্তু বৃথা; ভূমিগত সম্পত্তির পুঁজিকরণ আটকানো গেল না।
পুঁজি থেকে পার্থক্যের জায়গায়, ভূমিগত সম্পত্তি একটা ব্যক্তি সম্পত্তি- পুঁজি এখনো ক্লীষ্ট স্থানীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারে। এ সেই পুঁজি যা এখনো পর্যন্ত জগতের সাথে তালগোল পাকিয়ে যাওয়া থেকে ছুটে আসতে পারেনি, আর নিজের জন্য যথার্থ আঙ্গিকটি খুঁজে পায়নি- পুঁজি এখনো সম্পূর্ণ বিকশিত নয়। একে অবশ্যই এর অমূর্ততা অর্জন করতে হবে, যার মানে এর সৃষ্টিতত্ত্বের পথে এরই পরম প্রকাশ।
শ্রম, পুঁজি এবং এ দুয়ের সম্পর্কতে ব্যক্তি সম্পত্তির চরিত্র প্রকাশিত হয়। এ গঠনকারী উপাদানগুলোকে যে সঞ্চালনগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হবে তা হল :
[প্রথমত] এ দুয়ের প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ঐক্য।
প্রথমে পুঁজি এবং শ্রম ঐক্যবদ্ধই থাকে। তারপর আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তারা একে অপরকে পারস্পরিকভাবে বিকশিত হতে এবং এগিয়ে যেতে দেয় সদর্থক শর্ত হিসেবে।
[দ্বিতীয়ত] এরা পরস্পরবিরোধী; একে অপরকে বর্জন করে। শ্রমিক পুঁজিপতিকে তার নিজ অনস্তিত্ব হিসেবে জানে, উল্টোটাও ঘটে : একে অপরকে তার অস্তিত্ব হতে হরণ করে।
[তৃতীয়ত] প্রত্যেকের নিজেরই প্রতি বিপরীত অবস্থান। পুঁজি = মজুদ করা শ্রম = শ্রম। যেন সে* পুঁজির নিজের মাঝে এবং এর স্বার্থে টুকরো হয়ে গেছে আর এটাই পরে আবার স্বার্থ এবং মুনাফায় টুকরো হয়েছে। পুঁজিপতিরা সম্পূর্ণ উৎসর্গীকৃত। সে শ্রমিক শ্রেণীতে পতিত হয়, যখন শ্রমিক কেবল ব্যতিক্রম হিসেবে হয়ে ওঠে পুঁজিপতি , পুঁজির একটি ক্ষণ হিসেবে শ্রম- এর ব্যয় । এমনি করে শ্রমের মজুরী পুঁজির বলিদান।
শ্রম নিজে এবং শ্রমের মজুরীতে শ্রমের বিশ্লিষ্টকরণ। শ্রমিক নিজেই একটা পুঁজি, একটা পণ্য।
পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সংঘর্ষ।

পরবর্তী অংশ