Marxists Internet Archive
Bangla Section


অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

তৃতীয় পান্ডুলিপি: বুর্জোয়া সমাজে অর্থের ক্ষমতা

যদি মানুষের অনুভূতি, আবেগ এসব [সংকীর্ণ] দৃষ্টিতে নৃতাত্ত্বিক প্রপঞ্চ না হয়ে বরং সত্তার (প্রকৃতির) বাস্তব সত্তা বিঞ্চানগত অনুমোদন হয় আর যদি তারা শুধুমাত্র এজন্য অনুমোদিত হয় যে তাদের বিষয় এক সংবেদনগত বিষয় হিসেবে তাদের কাছে অস্তিত্বমান, তাহলে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্যাপারগুলো হল:
(১) কোনভাবেই কেবল তাদের একটি মাত্র অনুমোদনের ধরণ আছে এমন নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের, জীবনের পরিষ্কার স্বতন্ত্র চরিত্র গঠিত হয় তাদের স্বীকৃতির পরিষ্কার স্বতন্ত্র ধরণ দিয়ে। বিষয়টি যেভাবে তাদের জন্য অস্তিত্বমান থাকে তাই তাদের পরিতৃপ্তির বৈশিষ্ট্যগত ধরণ।
(২) সংবেদনগত অনুমোদন যেখানেই বিষয়ের স্বাধীন আঙ্গিকে (যেমন পানাহার, বিষয় নিয়ে কাজকর্ম ইত্যাদি) এর সরাসরি রদ্‌করণ, তা হল বিষয়ের অনুমোদন।
(৩) যদ্দুর পর্যন্ত মানুষ হিসেবে মানুষ এবং তার আবেগ অনুভূতি মানবিক, অন্যের দ্বারা বিষয়ের অনুমোদন একইভাবে তার নিজের পরিতৃপ্তি।
(৪) বিকশিত শিল্পের মাধ্যমে, তার মানে ব্যক্তি সম্পত্তির মাধ্যমের মধ্য দিয়েই কেবল মানব আবেগের সত্তাবিঞ্চানগত সারসত্তা এর সমগ্রতায়, একইভাবে এর মানবিকতায় সত্তাশীল হয়। তাই মানুষের বিঞ্চান নিজেই মানুষের হাতে- কলমের ক্রিয়ার উৎপন্ন।
(৫) এর বিচ্ছিন্নতা বাদে- ব্যক্তি সম্পত্তির মানে হল মানুষের জন্য সে মানুষের প্রামাণিক ক্ষমতার উপলব্ধিকে কেবল তার নিজের বিষয়ের অস্তিত্বশীলতা । উপভোগের বিষয় এবং ক্রিয়ার বিষয়- দুই হিসেবেই।
সবকিছু খরিদ করার, সব বিষয় যথার্থ করার বৈশিষ্ট্য ধারণ করার ফলে, অর্থ বিশেষ ধারণ সম্পন্ন বিষয়। এর বৈশিষ্ট্যের সার্বজনীনতা হল এর সত্তার সর্বশক্তিমানতা। তাই সে গণ্য হয় এক সর্বশক্তিমান সত্তা হিসেবে। মানুষের প্রয়োজন আর বিষয়ের মাঝখানে, তার জীবন আর জীবিকার মাঝখানে- অর্থই হল যোগানদার। তবে যা আমার জন্য আমার জীবনের মধ্যস্থতা করে, সে তো আমার জন্য অন্যান্য জনগণেরও মধ্যস্থতা করে। আমার জন্য তা হল অন্য ব্যক্তি।

"What, man I confound it, hands and feet
And head and backside, all are yours!
And what we take while life is sweet.
Is that to be declared not ours?
Six stallions, say, I can afford,
Is not their strength my property?
I tear along a sporting lord.
As it their legs belonged to me."


গ্যাটে ফাউস্ট: (প্রথম অংশ)

শেক্সপিয়ার বলেছেন টাইমস্ অব এথেন্স নাটকে:

"Gold? Yellow, glittering, precious gold? No, Gods,
I am no idle votarist! ... Thus much of this will
make black white, foul fair,
Wrong right, base noble, old young, coward valiant.
... Why, this
Will lug your priests and servants from your sides,
Pluck stout men's pillows from below their heads:
This yellow slave
Will knit and break religions, bless the accursed;
Make the hoar leprosy adored, place thieves
And give them title, knee and approbation
With senators on the bench : This is it
That makes the wappen'd widow wed again:
She, whom the spital-house and ulcerous sores
Would cast the gorge at, this embalms and spices
To the April day again. Come, damned earth,
Thou common whore of mankind, that putt'st odds
Among the rout of nations."

 

পরে আরো বলছেন :

"O thou sweet king-killer, and deat divorce
Twixt natural son and sire! thou bright defiler
Of Hymen's purest bed! thou valiant Mars!
Thou ever young, fresh, loved and delicate wooer,
Whose blush doth thaw the consecrated snow
That lies on Dian's  lap! Thou visible God!
That solder'st close impossibilitties.
And makest them kiss! That speak'st will every tounge,
 To every purpose! O thou touch of hearts!
Think, thy slave man rebels, and by thy virtue
Set them into confounding odds, that beasts
May have the world in empire!"

 

শেক্সপিয়র চমৎকারভাবে অর্থের আসল স্বভাবটা দেখিয়েছেন। তাঁকে বোঝার জন্য প্রথমে গ্যাটের উদ্ধৃতিটি বিচার করা যাক।
অর্থের মাধ্যমে আমি যা পাই- আমি যার জন্য পাওনা মেটাতে পারি (মানে অর্থ যা খরিদ করতে পারে)- সেই আমিই হচ্ছি আমার আমি। যে আমি অর্থের মালিক অর্থের ক্ষমতা যতটুকু, আমার ক্ষমতাও ততটুকুই। অর্থের গুণাবলীই আমার- মানে অর্থের মালিকের গুণাবলী আর অত্যাবশ্যকীয় ক্ষমতা। এমনি করে, আমি যা আর আমি যা করতে সক্ষম, তা কোনভাবেই আমার ব্যক্তিকতা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। আমি কুশ্রী, কিন্তু আমার জন্য আমি সবচাইতে রূপবতী রমণীটি খরিদ করতে পারি। অতএব আমি আর কুশ্রী নই, কারণ কুশ্রীতার প্রভাব এর বিকর্ষণ ক্ষমতাকে অর্থ দূর করে দিচ্ছে। ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যে আমি খোঁড়া, কিন্তু অর্থ আমাকে দু-চারটি নয়, চব্বিশটি পা দিয়ে সাজিয়ে দেবে। অতএব আমি আর খোঁড়া নই। আমি মন্দ, অসৎ, বিবেকবুদ্ধিহীন, নির্বোধ; কিন্তু অর্থ তো সম্মানের জিনিস- তাই অর্থের মালিকও সম্মানিত। অর্থ চরম শুভ, তাই এর মালিকও তাই। এর পাশাপাশি অর্থ আমাকে অসৎ হওয়ার যন্ত্রণা থেকে বাঁচায় : আমাকে তাই ধরে নেয়া হয় সৎ। আমি নির্বোধ, কিন্তু অর্থ হচ্ছে সবকিছুর আসল মগজ, তারপর আর কিভাবে অর্থের মালিক বুদ্ধিহীন হতে পারে? তাছাড়া আমি নিজের জন্য চতুর লোকদের কিনতে পারি। আর যে কিনা চতুর লোকদের উপর দাপটে বেড়ায় সে কি ঐসব চতুর লোকদের চেয়েও চতুর নয়? যে আমি অর্থকে ধন্য ধন্য করি সে আমি কি মানব হৃদয় যা কিছুর দিকে চেয়ে থাকে তার সব কব্জা করতে পারি না? সে আমি কি সব মানব সামর্থ ধারণ করিনা? তা হলে আমার অর্থ কি আমার সব অক্ষমতাকে ক্ষমতায় বদলে দেয় না?
যা আমাকে মানব জীবনের সাথে, সমাজকে আমার সাথে, আমাকে প্রকৃতি এবং মানুষের সাথে যুক্ত করে সেই বন্ধন যদি হয় অর্থ, তাহলে অর্থ কি সব বন্ধনের বন্ধন নয়? সে কি সব বাঁধনকে লুপ্ত করতে, বন্ধন করতে পারে না? তাহলে সে কি একই সাথে পৃথকীকরণের সার্বজনীন প্রতিনিধিত্বও নয়? এ হচ্ছে সেই মুদ্রা যা আসলেও আলাদা করে আবার সেই হল আসল বন্ধনের প্রতিনিধি- সমাজের [........] রাসায়নিক শক্তি।
শেক্সপিয়র বিশেষ করে অর্থের দুটো গুণের ওপর জোর দিয়েছেন:
(১) এ হল দৃশ্যমান ঐশ্বরিকতা- সমস্ত মানব এবং প্রাকৃতিক গুণকে তার উল্টোটাতে রূপান্তর, জিনিসের সার্বিক বিভ্রান্তি এবং বিকৃতি : সব অসম্ভবই অর্থ দিয়ে এক করে ঝালাই করা সম্ভব।
(২) এ হল জনগণ আর জাতির সাধারণ গণিকা, যোগানদার।
সমস্ত মানবিক এবং স্বাভাবিক গুণাবলীর বিভ্রান্তি ও বিকৃতি, অসম্ভাব্যতার ভ্রাতৃসুলভ গলাগলি- অর্থের ঐশ্বরিক ক্ষমতা; এসবই মানুষের বিচ্ছিন্ন, বিজাতীয় এবং আত্ম-ত্যাগী প্রজাতি চরিত্র হিসেবে এর চরিত্রের মাঝে নিহিত আছে। অর্থ হল মানবজাতির বিজাতকৃত সক্ষমতা ।
একজন মানুষ হিসেবে আমি যা করতে অক্ষম, আর তাই আমার ব্যক্তিক সমস্ত প্রামাণিক ক্ষমতা যাতে অসমর্থ - সে সবই আমি অর্থ দিয়ে করতে পারি। অর্থ এমনি করে এরকম প্রত্যেক ক্ষমতাকে এমন কিছুতে পাল্টে ফেলে, ঐ ক্ষমতাটি নিজে যা নয়। তার মানে, এগুলোকে এদের বিপরীত করে পাল্টে ফেলে।
যদি আমি বিশেষ কোন খাবার খেতে চাই, দূর্বলতার কারণে পায়ে না হেঁটে মেইল কোচে যেতে চাই, তাই হলে অর্থ আমাকে সেই খাবারও এনে দেবে, মেইল কোচও এনে দেবে। তার মানে অর্থ আমার ইচ্ছেগুলোকে কোন এক কল্পনার জগত হতে নিয়ে তাকে বদলে দেয়, তাদের ধ্যানকৃত, কল্পিত অথবা আকাঙ্খিত অস্তিত্ব হতে তাদের সংবেদনগত, বাস্তব অস্তিত্বে পাল্টে দেয়। অর্থ ইচ্ছাকে কল্পনা হতে জীবনে, কল্পিত সত্তা হতে বাস্তব সত্তায় বদলে দেয়। এই মধ্যস্থতা করতে গিয়ে [অর্থ] বাস্তবভাবেই সৃষ্টিশীল ক্ষমতা হয়ে উঠেছে।
সন্দেহ নেই, যার কোন অর্থ নেই তার জন্যও চাহিদা অস্তিত্বমান, তবে এই চাহিদা নিছক কল্পনার ব্যাপার। আমার জন্য এই চাহিদার কোন প্রভাবও নেই, অস্তিত্বও নেই; সে অস্তিত্বমান কোন তৃতীয় পক্ষ, [অন্যের] জন্য। এজন্য এই চাহিদা আমার কাছে এমনকি অবাস্তব আর বিষয়হীন হয়ে থেকে যায়।
অর্থভিত্তিক কার্যকর চাহিদা আর আমার প্রয়োজন, আমার আবেগ, আমার ইচ্ছা এসব ভিত্তিক অকার্যকর চাহিদার মাঝে পার্থক্য হচ্ছে সত্তা এবং চিন্তার মাঝের পার্থক্য, আমার মাঝে যা নিছক এক ভাব হিসেবে অস্তিত্বমান আর আমার বাইরে যে ভাব বাস্তব বিষয় হিসেবে অস্তিত্বমান তার মাঝের পার্থক্য।
ভ্রমণের জন্য আমার কোন অর্থ নেই, তাহলে আমার ভ্রমণের প্রয়োজনও নেই, তারমানে কোন বাস্তব আর উপলব্ধিযোগ্য প্রয়োজন নেই। পড়াশোনায় আমার বিশেষ ঝোঁক, কিন্তু এর জন্য অর্থ নেই তাহলে আমার পড়াশোনায় কোন ঝোঁকও নেই, মানে কোন কার্যকর, বাস্তব ঝোঁক নেই। আবার অন্যদিকে, পড়াশোনার জন্য যদি আমার বাস্তবিক ঝোঁক নাও থাকে কিন্তু তার জন্য ইচ্ছা আর অর্থ থাকে, তাহলে একটা কার্যকর ঝোঁকও হয়ে যাবে। প্রতিচ্ছবিকে বাস্তবতায় আর বাস্তবতাকে নিছক প্রতিচ্ছবিতে বদলে দেবার সার্বিক মাধ্যম এবং বিভাগ হিসেবে অর্থ (মানুষ হতে মানুষ হিসেবে বা মানব সমাজ হতে সমাজ হিসেবে উৎসারিত হয়ে নয়) মানুষ এবং প্রকৃতির বাস্তব প্রামাণিক ক্ষমতাকে কেবল নিছক অমূর্ত ধারণায় রূপান্তরিত করে। ফলে তা হয়ে যায় অসম্পূর্ণতা আর যন্ত্রণাদায়ক এক কিম্ভূত দানব। এমন করেই তা বাস্তব অসম্পূর্ণতা, কিম্ভূত দানবগুলোকে রূপান্তরিত করে বাস্তব ক্ষমতা এবং বিভাগে (কেবল স্বতন্ত্রের কল্পনাতেই তারা অস্তিত্বমান)। শুধু এই বৈশিষ্ট্যের আলোকেই, অর্থ এভাবে হয়ে যায় স্বতন্ত্রতার সাধারণ বিকৃতি। এই বিকৃতি, তারা যা তাদেরকে তার উল্টো করে দেয়, তাদের গুণাবলীর ওপর পরস্পরবিরোধী গুণাবলী আরোপ করে।
তারপর অর্থ এই বিকৃত ক্ষমতা হিসেবে আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র এবং সমাজ বন্ধন দুইয়েরই বিপরীতে (যা কিনা নিজেদের মাঝে অন্তর্বন্ধন হবার দাবি করে)। এটা বিশ্বস্ততাকে অবিশ্বস্ততায়, ভালোবাসাকে ঘৃণায়, ঘৃণাকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করে। এটা গুণকে দোষে, দোষকে গুণে, ভৃত্যকে প্রভুতে, প্রভুকে ভৃত্যে, বেকুবীকে বুদ্ধিমত্তায় আর বুদ্ধিমত্তাকে বেকুবীতে রূপান্তরিত করে।
মূল্যবোধের বহাল এবং সক্রিয় ধারণা হিসেবে অর্থ সব জিনিসকে বিভ্রান্ত করে, গুলিয়ে ফেলে। তাই অর্থ হল সব জিনিসের সাধারণ বিভ্রান্তি এবং বিশৃঙ্খলা- উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জগত, সব স্বাভাবিক আর মানবিক গুণাবলীর বিমূঢ়তা, তালগোল পাকিয়ে ফেলা।
কোন ভীতুর ডিমও যদি সাহস কিনতে পারে তবে সেই সাহসী। অর্থ কোন বিশেষ গুণ, কোন একটি বিশেষ জিনিসের জন্য অথবা কোন বিশেষ প্রামনিক মানবিক ক্ষমতার জন্য বিনিময়িত হয় না, বরং এর বদলে মানুষ এবং প্রকৃতির তাবৎ জগত পাওয়া যায়। তাই অর্থের মালিকের অবস্থান হতে অর্থ যে কোন গুণাবলীর বিনিময়ের কাজ করতে পারে, তা পরস্পরবিরোধী হলেও অসুবিধে নেই। অর্থ হল অসম্ভবগুলোর ভাই ভাই হয়ে যাওয়া, এর হাতে পরস্পরবিরোধিতাও গলাগলি করে।
মানুষকে মানুষ ধরে নেয়া যাক, জগতের সাথে তার সম্পর্ককে ধরে নেয়া যাক একটা মানবিক সম্পর্ক : তাহলে তুমি প্রেমকে কেবল প্রেম, বিশ্বাসকে বিশ্বাস দিয়ে বিনিময় করতে পারবে। তুমি যদি শিল্প উপভোগ করতে চাও তাহলে তোমায় শিল্প চর্চিত ব্যক্তি হতে হবে। তুমি যদি অন্য লোকদের ওপর প্রভাব খাটাতে চাও তাহলে তোমাকে অবশ্যই এমন মানুষ হতে হবে যে কিনা অন্যদের ওপর প্রেষণাদায়ক, সাহস দেয়া প্রভাব রাখতে পারে। মানুষ এবং প্রকৃতির সাথে তোমার প্রত্যেকটা সম্পর্ক অবশ্যই এক বিশেষ প্রকাশ হতে হবে, যা কিনা তোমার ইচ্ছা, তোমার বাস্তব স্বতন্ত্র জীবনের সাথে তাল মেলানো। যদি তুমি ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসার কথা মনে না রেখেই ভালোবাসো- মানে ভালোবাসা হিসেবে যদি তোমার ভালোবাসা পারস্পরিক প্রেম উৎপন্ন না করে, যদি প্রেম করা মানুষ হিসেবে তোমার নিজের এক জীবন্ত প্রকাশের মাধ্যমে তুমি নিজেকে একজন ভালোবাসার মানুষ করে তুলতে না পারো, তাহলে তোমার প্রেম অক্ষম- এক দূর্ভাগ্য।

পরবর্তী অংশ